কাজী স্বপন, ওয়াশিংটন ডিসি!
বেপরোয়া কথা ও নিজেকে সংবরন করা জরুরী শিরোনামে” দৈনিক ইত্তেফাকে আমার একটি বিশ্লেষনমূলক লিখা॥পড়লে উপকৃত হবেন। শিউর॥
অনেকেই আছেন যারা ছুটির দিনের নিজেদের অনেক অনুল্লেখযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় গল্প বলে সোমবারের অফিসের আমেজ ও সময় নষ্ট করে সহকর্মীদের বিরক্ত করে ধৈর্যচুত্যি ঘটান। তারাই হুট করে খাবার টেবিল, সকালের নাস্তা বা দুপুরের লান্চে সকলের মুখের উপরে হুলস্তুল করে কথা বলতে শুরু করে। তারাই পাড়া প্রতিবেশির আমন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই বাসায় হাজির হয়ে একই শুনা বা বার বার বলা গল্প ঘন্টার পর ঘন্টা বলতে থাকেন। তারাই কলিগ হয়েও মিটিং এ আপনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বেপরোয়া বক বক করতেই থাকবে। তাদেরই কেউ হয়ত কোম্পানির সি ই ও যেকিনা তার নিজের রেকলেস টুইটের জন্যে সিকিউরিটি বা জালিয়াতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাও ভোগ করে এসেছে, তবুও বেশি কথা বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি এখনও।
ব্রিটিশ প্রিন্স থেকে শুরু করে আমরা অনেকেই মিডিয়ার কঠোর সমালোচনা করে আবার এই মিডিয়ার মাধ্যমেই নিজেদের প্রচার প্রপাকান্ড চালিয়ে যাই।
আমাদের মতো ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষাভাষীদের বেশি কথা বলার জটিলতা আরও ভয়ংকর হয়। অনেকই বাংলার সাথে ইংরেজীর সহজ সরলার্থে কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করে যার অর্থ অনেক সময় বীপরিতমুখী হয়ে যায়। কেননা ব্যাবহারের স্হান কাল পাত্র ভেদে একই ইংরেজী শব্দের ভিন্ন অর্থ হয়। অনেকেই তা না বোঝেই ব্যাবহার করে।
সত্যিকার অর্থে আমরা অধিকাংশই এই একই গোত্রের, যার জন্যে আমরা কেউই ব্যাক্তিগত ভাবে দায়ী নই। আমাদের সমাজ ব্যাবস্হাই এই ধরনের বেশি কথা বলাকে শুধু এপ্রিশিয়েট ও এনকারেজই করেনি, পুরোপুরি বাস্তবে ডিমান্ডও করে, যেখানে জীবন বা কর্মের সাফল্য নির্ধারিত বা পরিমাপ হয়, আপনি আপনার পরিমন্ডলে মনুষ্য সমাজে কতটুকু এটেনশান বা মনোযোগ আকর্ষন করতে পেরেছেন তা দিয়ে। আপনার কতমিলিয়ন টুইটার ও ফেসবুক ফলোয়ার আছে। আপনি কত প্রভাবশালী ইনষ্ট্রগ্রামার, আপনার পোষ্ট ভিডিও ভাইরাল হওয়া, ইউটিউবে দর্শক প্লাবিত হওয়া, লক্ষ লক্ষ্য চ্যাটিং ও ষ্ট্রিমিং হওয়ার মধ্য দিয়ে সাফল্য নির্ধারিত হয়।
শুধু আমেরিকায়ই প্রতিদিন দুই মিলিয়নেরও বেশি পডকাষ্ট প্রতিনিয়ত ৪৮ মিলিয়ন ইপিসোড তৈরি করছে। তিন হাজারেরও বেশি টেড এক্স ইভেন্টস বিশ ওয়ানাবে মালকলম গ্লেডওয়েলস অংশগ্রহন করে প্রতিবছর। শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ভার্চুয়াল মিটিং আয়োজন করা হয়। এর সবই কি অবশ্য করনীয়? জরীপে প্রমানীত হয়েছে যে এর অর্ধেকই সময়ের অপচয়। মানুষ শুধু শুধুই টুইটের জন্যেই টুইট করে, কথা শুধু বলার জন্যেই বলে। অথচ পবিত্র আল কোরানসহ প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই মুখ ও হাত থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার কথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে বর্নিত আছে।
কিন্তু বাস্তবে এখনও অনেক বিখ্যাত, সফল, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মানুষ আছেন যারা ঠিক এর বীপরিতটি করেন। মানে কথা বলেন কম। বেশি কথা বলাত দূরে থাক, অতীব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া মুখ খোলেন না। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের বদলে তারা মনুষ্যদৃষ্টি এরিয়ে চলতে পছন্দ করেন। নীরবে নি:শব্দে মানুষের, সমাজ ও পৃথিবীর কল্যানে কাজ করে যান।
তাদের কথা বলায় তারা যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করেন। যেমন আপেলর সি ই ও টিম কোক কথা বলেন সময় নিয়ে, ভেংগে ভেংগে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণেই অত্যন্ত সতর্কতায় শব্দ চয়ন করেন, যেন ভুল শব্দ ব্যাবহ্রত না হয়। কেননা মুখ ফসকে বেফাস কথা বের হলে তা আর পুরোপুরি ফেরত নেয়া যায় না। বিগত চার দশক জুড়েই জো বাইডেন, বারাক ওবামারা ছিলেন কথার বলার রাজা। আড্ডাবাজ, গল্পবাজ, নামকরা নেগোসিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারী। ইংরেজিতে যাকে বলে টকেটিভ, হোক সে সমাজ ঘর সংসার বা রাজনীতি নিয়ে। তারা তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বচনের ক্যাম্পেইন শুরু করার সাথে সাথেই কথা বলাতেও নিয়ন্ত্রন আরোপ করে মেপে মেপে হিসেব নিকেশ করে সময় নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। কম কথা বলার চর্চা শুরু করেন এবং সফলও হন। স্হীর ধীর গতিতে, যে কোন প্রশ্নের একদম সংক্ষিপ্ত উত্তরে পারংগমতার প্রশিক্ষন নিয়ে তা রপ্ত করতে সমর্থ হোন শতভাগ।
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও ছিলেন একদম কম কথা বলা অন্তর্মুখি মানুষ। যিনি প্রয়োজনেও কথা না বলে, নিরবতাকে ভালোবেসে নির্জন নি:স্তদ্ধতাকে ব্রত বলে গ্রহন করেছিলেন অন্তরথেকে। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বেডার গিন্সবার্গ অত্যন্ত সতর্কতা নিয়ে তার শব্দ চয়ন করতেন। প্রতিটা শব্দ উচ্চারণের মাঝে সময় নিতেন। হিয়ারিং এর মাঝে শুনানিতে দুই শব্দের মাঝখানে তুলনামূলক লম্বা ব্রেক নিয়ে দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারন করতেন। তা করতে গিয়ে তিনি তার ষ্টাফসহ মিসিসিপি এক, মিসিসিপি দুই নামক একটি অদ্ভুত নীতি ব্যাবহার করতেন। তার কথার দুই শব্দের মাঝে তিনি ও তার ষ্টাফরাও উচ্চারন করতেন এক মিসিসিপি, দুই মিসিসিপি এবং এর পরে পরবর্তি শব্দটি উচ্চারন করতেন। যাতে কোন ক্রমেই ভুল শব্দ ব্যবহার না হয়। আমরা প্রেসিডেন্ট, টেক কোম্পানীর সি ই ও, বৈজ্ঞানিক বা সুপ্রীম কোর্টের বিচারক না হলেও ব্যাক্তি জীবনে একজন সফল মানুষ হয়ে পরিবার সমাজে অন্তত সাধ্যমত একটা সুন্দর গঠন মূলক, মানুষকে প্রভাবিত করার মতো একটা ইমেজ তৈরিত অবশ্যই করতে পারি। চাকুরিতে প্রমোশন, সমাজের গুডবুকে নাম লিখাতেত অসুবিধে হবার কথা নয়। অন্তত নিজের অসংযত মুখকে সাট দা F—আপ করা যায়।
ভুল বিশ্লেষন, মানুষের কথার মাঝখানে কথা কেড়ে নিয়ে কথা বলা শুরু করা, কথার উপরে কথা বলা অনেকেরই সহজাত প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তির মাধ্যমেই মানুষের সাথে মানুষের শুধু ব্যাক্তিগত সম্পর্কই নষ্ট হয় না, নষ্ট হয় সমাজ ও পরিবার। এটা অনেকেরই ব্যাক্তিগত সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, যখন সে, নিজেকে কোন কিছু থেকেই দমিয়ে রাখতে পারে না, বা নিজের নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা হারিয়ে, নিজের মধ্যে কোনকিছুই সন্চিত বা গোপন করার সকল ক্ষমতা হারিয়ে আত্বনিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ে। নিজের অজ্ঞতা, অপরাগতা এ অপরাধ বোধকেও চেপে রাখতে পারে না। এই অতিরিক্ত অতিরন্জিত বেশি কথা বলার কারনে কখনও কখনও সে তার চাকুরি হারায়, কখনও দাম্পত্য জীবনকেও বিষময় করে তোলে। সংসার ভাংগে। ঘর সংসার বিষময় হয়, সন্তানের সংগেও সম্পর্ক থাকেনা। হয়ত একই ছাঁদের নীচে থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলে না। হতাশা, অবিশ্বাস, ফ্রাষ্টেশনের কারনে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে এই বেশি কথা বলাই নিজ জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রশ্ন আসে মানুষ কেন এমন কম্পালসিভ টকার বা বেশি কথা বলায় আসক্ত হয়ে পুরো নিয়ন্ত্রনহীন হয় এবং এর থেকে পরিত্রান পাওয়ার কি উপায়।
এই বেশি কথা বলার সমস্যাকে ইংরেজিতে বলা হয় টকালিজম ( talkholism), যাকে চূড়ান্ত অতিরন্জিত কথা বলা ( extreme overtaking) ও বলা যায়। বেশি কথা বলা পরিমাপের জন্য বা আপনি কতটুকু বেশি কথা বলেন তা জরিপের জন্য টাইম.কম/টক লিংকে গিয়ে কুইজে অংশ নিয়ে তা পরিমাপ করতে পারেন। ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এই স্বেচ্ছাচালিত টেষ্ট জরীপটি আবিস্কার করে। এই বেশি কথা বলা একটি আসক্তি, এটি আবার তাদের চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখলেও অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত রাখতে না পারা, নিজস্ব বা পেশাগত সমস্যা তৈরি করতে পারে। একজন বেশি কথা বলা লোক ইচ্ছে করেই তার বেশি কথা বলা বন্ধ করতে পারে না। মানুষ পছন্দ করুক বা না করুক, তাকে টকেটিভ ভাবুক বা না ভাবুক কেউ তার কথায় আহত হোক বা না হোক, এসব না ভেবেই কথা সে বলতেই থাকবে।
মেডিকেল বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা তাদের রিসার্চে বলেছেন যে, এই বেশি কথা বলাটা বায়োলজিক্যাল বা প্রিনেটাল, অর্থাৎ মায়ের পেটে মানব দেহ সৃষ্টির সাথে সাথেই সৃষ্টি হয় যা ন্যাচারাল। মানুষ যখন কিছু করে বা দেখে তার ব্রেইন আলোকিত হয়। যখন কথা না বলে চুপ করে থাকে বিশ্রাম নেয় তখন ব্রেইন সেল বাড়ে। মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মাইকেল বেটি ২০১০ এ আবিস্কার করে যে, বেশি কথা বলা মানুষের ব্রেইনে খেলে যাওয়া ঢেউয়ে ব্যালেন্স হীনতার ফল । ব্রেইনের ত্রুটি বা সমস্যা বলা য়ায়। যা ব্রেইনের নিউরন এক্টিভিটি, ব্রেইনের বাম ও ডানের আভ্যন্তরিন দুই ভাগের নিউরনের কার্যকারিতার উপর এটি নির্ধারিত হয়। ডান পাশের নিউরনের কার্যকারিতা বেশি হলে সে বেশি কথা বলে আর বামেরটার বেশি হলে কম কথা বলে। এটি বিজ্ঞান যা অনেকটা মনোবিজ্ঞানিকও বলা যায়। তাই বেশি কথা বলা মানুষ সহজেই উত্তেজিত হয়ে ডেসপারেট বা এগ্রেসিভ হয়ে যে কোন অঘটন ঘটাতে পারে। তাদের নিজেকে নিয়ন্ত্রন বা সংযত করার ক্ষমতা অতি সীমিত।
মাদকাসক্তদের মতোই টকেটিভ বা টকালিজমে আক্রান্ত মানুষেরা সহজেই এর থেকে মুক্ত হতে পারে না, তবে চেষ্টা করে আস্তে আস্তে কমিয়ে এনে এক সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হতে পারে। কেননা ব্রেইন সেলের নিউরন বাড়ানো কমানো সহজে সম্ভব হয় না। তবে আধুনিক জগতে কম কথা বলার জন্যে বা নিজেকে শান্ত রাখার কাউন্সিলিং আছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজবীদ, বৈজ্ঞানিক ও মনেবিজ্ঞানীসহ ডাক্তার বিশেষজ্ঞগন মনে করেন মৌনতা বা নিরবতা ব্রেইন সেল তৈরি করতে সাহার্য করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাইকোলজিষ্ট তার আবিস্কৃত ফরমুলা দিয়ে জেলের কয়েদির মুখ বন্ধ রাখার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। তার মধ্যে সোসাল মিডিয়া পুরোপুরি ত্যাগ করা, জুম কল মিটিং, যত সম্ভব কম ফোনালাপ করা, বা কথা সংক্ষিপ্ত রাখা, উঁচ্চ স্বরে কথা না বলা, কম্পিউটার স্ক্রীনের পাশে কাগজে লিখে, কথা বলা কম, শুনা কম,সংক্ষিপ্ত উত্তর ও কথা যথাসম্ভব তাড়াতাডি শেষ করার নির্দেশনা লাগিয়ে রেখে উপকৃত হবার চেষ্টা করা যায়। তবে অবশ্যই কথা বেশি বলার চেয়ে বেশি শুনা উপকারী।
যতটুকু সম্ভব কথা কম বলার চেষ্টা করা। কথা বলা বা শব্দের অপচয় মানে টাকার অপব্যাবহার করা হিসেবে বিবেচনা করা।
কথা বলায় বিরত থাকার ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করা, এক্ষেত্রে অন্যদেরকে কথা বলতে দিয়ে নিজে শুনার চেষ্টা করা।
সোসাল মিডিয়া টুইটার, জুম, ফেসবুক, ইউটিউব থেকে দূরে থাকা ।
নিরবতার চর্চা করা বা নিরব থাকার ক্ষমতা আয়ত্ব করা।
কিভাবে শান্ত হয়ে শুনতে হয় তার চর্চা বা অভ্যাস করা। অন্যের প্রতি অধিক মনেযাগী হয়ে অন্যকে গুরুত্ব দেয়া।
আমাদের অধিকাংশই শ্বাস নেবার মতোই কোন কিছু না ভেবেই কথা বলতেই থাকি নিজের অজান্তেই। কিন্ত কথা বলায় সতর্ক হলে বা বোঝে শুনে কথা বললে আমরা সহজেই চিন্তায় আসতে পারে কেন আমরা এভাবে বেপরোয়া কথা বলছি, যা মোটেই উচিত নয় বা স্বাস্হ্যের বা সুস্ততার জন্যে অমংগলকর। এভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে ভালো ম্যাজিকেল ফলাফল পাওয়া যায়। ইমোশনালি, পিজিক্যালি ও মেন্টালি ভালো অনুভব করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাক্তি সংসার সমাজ জীবনের চালচিত্র পাল্টাতে শুরু করে নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা মনে হতে পারে। পরিবারের সকল সদস্যকেই মনে হতে শুরু করবে পজেটিভ॥