বিশ্বের একনাম্বার অভিনেতা হলিউড নায়ক, ২০২২ সালের অস্কার বিজয়ী উইল স্মীথ ঘটনার নয় মাস পর আবারও কৌতুক তারকা ও ঐ অনুষ্ঠানের সন্চালক ক্রীস রককে চড় দেয়ার অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ভুল স্বীকার করে আমেরিকান জাতীয় টিভির এক অনুষ্টান ‘দি ডেইলী শো’ এর সন্চালক ট্রেভার নোহের মাধ্যমে দু:খ প্রকাশ করেছেন এবং ক্রীস রকসহ দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতি সম্প্রতি তার অভিনীত সাড়া জাগানো সিনেমা ‘ ইমানসিপেশান’ এর বানিজ্যিক শুভমুক্তি অনুষ্ঠানে অস্কারের ঐ রাত্রিটিকে তার জীবনের এক চরম ভুল, বিভ্রান্তিমূলক, ও নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলার মূহূর্ত বলে মন্তব্য করেন। ঘটনার রাতসহ এর আগেও তিনি একাধিকবার টিভি, পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় নিজের অপ্রত্যাশিত ভুল স্বীকার করে অনুশোচনা করেছেন। ক্রীস রক এখনও পর্যন্ত তাকে হাত ধরে সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটি পর্যন্ত দেননি বলেও উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি নি:সন্দেহে অন্যসকলের জন্য খুবই দু:সহ, অসহ্য, কঠিন ও বেদনাদায়ক ছিল। স্মিথ বলেন, ঐ রাত্রিতে তিনি নিজেকে মনের অজান্তে যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, আসলে তিনি আদৌ তেমনটি হতে চাননি, এখনও চাননা, তাই এই দু:খবোধ তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
স্মীথ সহজেই অনুমান করতে পারছেন যে, অস্কার রাতে তার অভিনেত্রী স্ত্রী জাডা পিংকেটের মাথার চুল হারানো নিয়ে ক্রীস রকের করা কৌতুকের জন্য চটে গিয়ে চড় মারার মত জঘন্য কাজ করায় সাধারন দর্শকগন তার এই ঐতিহাসিক সিনেমাটিও দেখতে তেমন আগ্রহী হবে না। যদিও সিনেমাটি সেই সময়ের ক্রীতদাস প্রথা ও আফ্রিকান আমেরিকানদের সংগ্রামী জীবন আলেখ্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।
অস্কার ঘটনার রাতেই তার স্ত্রী, মাতা, ও ভাই বোনেরাও এ ঘটনায় বিস্মিত হন, ও নিজের স্ত্রী জাডা স্মিথের এই বাড়াবাড়িতে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
গত জুনেও উইল স্মিথ এক সাক্ষাতকারে কৌতুক অভিনেতা ও ঐ অনুষ্ঠানের সন্চালক ক্রীস রককে থাপ্পড় মারার জন্যে প্রকাশ্যে দু:খ প্রকাশ করে ক্রীস রকসহ তার ভক্ত, অনুসারি ও জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বিবৃতিত এও বলেছেন যে, অস্কার নাইটের সেদিনেই ঘটনার কিছুক্ষন পরেই তিনি রকের কাছে গিয়ে দু:খ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলেন কিন্ত রক তাতে রাজী হননি। এখনও পর্যন্ত রক তাকে হাত ধরে সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটি দেন নি।
কেন দেন নি, সেটা রকই ভালো জানেন। তবে আমাদের নাট্যকার প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, অন্যায়কারীর বড় প্রতিশোধ নেয়াই হলো তাকে মাফ করে দেয়া বা উল্ঠো তার উপকার করে দেয়া। ক্রীস রক হুমায়ুন পড়ে নাই তাই হয়ত সে তা করেনি।
ক্রীস রক উইল স্মিথের স্ত্রীর মাথার চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে কৌতুক করায় স্মিথ রাগ সামলাতে না পেরে মন্চে গিয়ে কষে থাপ্পড় মারার সাথে সাথে সেখানে দায়ীত্বরত আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা তাকে এরেষ্ট করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পাশাপাশি অস্কার জিরেক্টরস বোর্ডও তাদের ভার্চুয়াল মিটিংএ তার শ্রেষ্ট অভিনেতা নির্বাচিত হওয়া বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। শুধু দরকার ছিল থাপ্পড় খাওয়া ক্রীসের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ। তখনও শ্রেষ্ট অভিনেতা হিসেবে তার নাম ঘোষিত হয় নি। ক্রীস রক এত বড় সুন্দর এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির ধারাবাহিকতা ও সৌন্দর্য নষ্ট করতে চান নি বলে তিনি সে পথে যাননি। ঘটনাটি সারা বিশ্বে সকল মিডিয়ায় আলোড়ন তুলে। দেশ বিদেশে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা চলে। বাংগালি কমিউনিটির অনেকেই ফেসবুকে পক্ষে বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। রকের পরবর্তি ছয়মাসের সকল অনুষ্ঠানের সব টিকেট রাতারাতি বিক্রি হয়ে যায়। তাৎক্ষনিক ভাবে তার জনপ্রিয়তা প্রায় দ্বিগুন পরিমান বেড়ে যায়।
অস্কার কর্তৃক শ্রেষ্ট অভিনেতা নির্বাচিতদের সাধারণত আমেরিকার বড় এবং জনপ্রিয় সেলিব্রেটি, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে গন্য করা হয়। কিন্ত উইল স্মিথের বেলায় একটি মাত্র চড় বা থাপ্পড়ের জন্য ঘটে তার উল্টোটি।
ইংরেজীতে ষ্টেরিওটাইপ বলে একটা কথা আছে। যার মানে হল কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকা, ধরন, ধর্ম, রং ও গোত্রের মানুষের প্রতি কিছু প্রচলিত ধারনা বা বিশ্বাস। যেমন আফ্রিকান আমেরিকান বা কালোদের ঘাড় বাঁকা। চট করে রেগে যায়। গত অস্কার অনুষ্ঠানে উইল স্মিথের মন্চে গিয়ে ক্রীস রককে চড মারার ঘটনাটি এই ষ্টেরিও টাইপের প্রবনতাকে আরও জোড়দার করেছে।
জোক আমেরিকান কালচারের একটি বড় অনুসঙ্গ। রাজনীতি তথা হোয়াইট হাউজ থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষক এমনকি চিকিৎসগনও জোক করেন।
রাজনৈতিক সচেতন আমেরিকান বা নিয়মিত টিভি সংবাদ দেখেন সকলেই জানেন যে, সাবেক প্রেসিডেন্টদের পরিবারের সংগে বর্তমান প্রেসিডেন্টের পরিবারের অত্যন্ত সুসম্পর্ক থাকে দলমত নির্বিশেষে। (শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাতীত)। এটি আমেরিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি শুভদিক। জর্জ ডাবলিউ বুশের ( ছোট বুশ) পরিবারের সংগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিবারের খুবই সুন্দর মননশীল সম্পর্ক। দুই পরিবার একত্রিত হলেই হাসি ঠাট্রায় আড্ডা জমে উঠে। বিশেষ করে জর্জ বুশ ও মিশেল ওবামার মধ্যে কথোপকথনের হাস্য রস সবারই দৃষ্টি কাঁড়ে।
এ বিষয়টিকে উপলক্ষ্য করে আমেরিকার বিখ্যাত ‘ লেট নাইট শো জিমি কিম্মেল লাইভ’ এর সন্চালক, অন্যতম অস্কারসহ বিভিন্ন বিখ্যাত অনুষ্ঠানের সন্চালক জিমি কিমেল তার এক অনুষ্ঠানে মিশেল ওবামাকে গেষ্ট হিসেবে এনে, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সংগে তার কেমন গভীর ও কতদিনের প্রনয় তা ঠাট্রা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন। এ নিয়ে সর্ব স্বয়ং বারাক ওবামা, জর্জ বুশ, তার স্ত্রী লরা বুশ ও মিশেল ওবামাসহ দর্শকেরা হাসিতে ফেটে পড়ে। শুধু তাই নয়, অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের পরদিনই অধিকাংশ জাতীয় টিভির অনুষ্ঠানে হাস্য রসের মাধ্যমে আলোচিত হয়। কোন আমেরিকানই এটিতে হাস্য রসের বাইরে অন্যকিছুই খোঁজে বের করেনি।
এইত সেদিন, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর স্বাস্হ্য নীতি (ওবামা কেয়ার) সংক্রান্ত একটি আইনের নতুন সংস্করন অনুষ্টানে এসে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বক্তৃতার শুরুতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জোক করেই আমার ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে সম্ভোধন করেন। পরে হেসে আবার মি. প্রেসিডেন্ট বলে তার আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও মাই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলে তার বক্তব্য শুরু করেন। এরকম হাজারও ঘটনার উপমা দেয়া যাবে।
পাশাপাশি কিল, ঘুষি, বা চড় বাংগালী সংস্কৃতির অংশ বলেই প্রবাদে আছে, ভাত দেয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোসাই। মানে খুব পরিস্কার, খাওয়তে পড়াতে পারলে চড় কিল থাপ্পড় মারা যায়। সেটা সম্পর্ক, সম্পদ, জ্ঞান, বা বয়সে ছোট বা দূর্বল হলে তা করা সহজ। এগুলো তুচ্ছার্থে শাসন বা অপমানের হাতিয়ার। যত নিষ্ঠুর, ক্ষতিকর বা বিপজ্জনকই হোক না কেন যে কোন অজুহাতে গায়ে হাত দেয়া অত্যন্ত মামুলি বিষয়। অথচ যতই শিক্ষিত হোন বা যে পদেই আসীন হোন না কেন, মানুষের গায়ে হাত তুলা, লাঠি, বেত দিয়ে পিটানো বা আঘাত করা অসভ্যতা, বা আদিম হিংস্রতা। সভ্যতার পূর্বে মানুষও পশু, জন্তু বা জানোয়ারের মত গায়ের জোড়ে কথা বলত বা শক্তি খাটাত এটি তারই নামান্তর।
অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক শাসনের প্রভাব সন্ত্রাস ও মাসলিজমের আধিপত্য পাকিস্তান আমল থেকেই স্বক্রীয় ছিল। ৭৫ পরবর্তিতে তা প্রাতিষ্টানিকতা লাভ করে। ছাত্ররাজনীতির হল, ক্যাম্পাস, কলেজ দখল, ঠিকাদারী ও মাশোহারা নেয়া, চাঁদা ও টেন্ডার বাজীসহ সবকিছুর মূল নিমিত্ত হলো শক্তির আরোপ। মূল রাজনীতির চড়, এলাকা পাড়া বাজার মহল্লা দখল,বড় ও প্রভাবশালী নেতাদের কথায় কথায় ছোট নেতাসহ কর্মীদের ধমক,গায়ে হাত তোলা, এমনকি জনপ্রতিনিধি ও গনপ্রশাসনসহ সরকারী কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের চড় থাপ্পর দিয়ে শাসনের কালচার সর্বজনবিদিত। বড় দলের বিরাট বিশাল নেতৃত্বকেও নিজদলের ছোট এমপি নেতাকে চড় দিয়ে, ছোট ভাইয়ের শাসন বলে মন্তব্য করে পার পেয়ে যেতেও দেখা গেছে, যা নিয়ে কোনরুপ প্রতিবাদ, দু:খ প্রকাশ, নিন্দা না হওয়াই প্রমান করে যে, চড় থাপ্পড়ের প্রাতিষ্টানিক রুপ কতটা শক্তিশালী।
দু:খজনক হলেও সত্য যে, কোন এক সময় আমাদের স্কুল, কলেজ, সমাজ, ঘর সংসার ও রাজনীতি সব খানেই কিল, চড় ও থাপ্পড় প্রচলিত ছিল। এখনও যে নেই তা বলা যাবেনা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে হাই স্কুল পর্যন্ত এই সংস্কৃতি এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল। কানমলা বা বেতের বাড়ি, দু একটা চড় থাপ্পড় খায়নি এরকম ছাত্র আমাদের সময় পাওয়া ছিল দুষ্কর।