আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন

19

কাজী স্বপন, ওয়াশিংটন ডিসি

আমেরিকার সাম্প্রতিক মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল নতুন ও অপেক্ষাকৃত তরুন নেতৃত্বকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে ভবিষ্যত রাজনৈতিক আবহকে পাল্টে দিতে শুরু করেছে। দেশের রাজনৈতিক সচেতন মহল, মিডিয়া, রাজনৈতিক বিষেষজ্ঞ, ও পন্ডিত গনের সকল জরীপ, পর্যবেক্ষন ও বিশ্লেষনকে পাশ কাটিয়ে জনগন একটি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দুটি রাজনৈতিক দলের গ্রহনযোগ্যতা ও শক্তি সামর্থ্যকে নূতন রুপে উপস্থাপন করেছে। “কেউ কাউকে নাহি ছাড়ে সমানে সমান” দুদলের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা যেন বাংলা এই প্রবাদ বাক্যকেরই প্রতিফলন। যে কারনে বিজ্ঞজনের ধারনা মোতাবেক নির্বাচনী ফলাফলে তথাকথিত রেড ওয়েভ (লাল ঢেউ) আসেনি বা ঘটেনি। অর্থাৎ আমেরিকান রাজনীতির ধারাবাহিকতায় সকল প্রেসিডেন্টদের প্রথম মেয়াদের এই মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে কংগ্রেসের সিনেট ও হাউজে বিরোধীদলকে ব্যাপক বিজয় দিয়ে শক্তিশালী অবস্হানে নিয়ে আসে। সচেতন জনগন সাধারণত এটি করেন রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি বা চেকস এন্ড ব্যালেন্স আনার নিমিত্তে। এবারের এই নির্বাচনে বিরোধী রিপাবলিকান দল হাউজে অল্প সংখ্যক (৫/৬) আসনের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সিনেটে, ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পূর্বের চেয়েও আরও শক্তিশালী অবস্হানে চলে আসে। পূর্বে সিনেটে দুদলেরই সমান সমান আসন ছিল, এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সিনেটের সভাপতি ভাইস প্রেসিডন্টকে ভোট দিয়ে, টাই ভাংতে হত। এবার ডেমোক্র্যাটরা ইতিমধ্যেই একটি রিপাবলিকান আসন ছিনিয়ে এনে সুবিধাজনক অবস্হায় আছে। জর্জিয়ার অনির্র্ধারিত আসনে তারা এগিয়ে থাকলেও ৫০% ভোট না পাওয়ায়, আগামী ডিসেম্বরের ছয় তারিখে পুনরায় রান অফ নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে আসতে হবে। ডেমোক্র্যাট দলীয় রাফায়েল ওয়ারনেক সিটিং সিনেটর এবং এবারও ভোটে আগানো, তাই তারই জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। আর তা হলে ডেমোক্র্যাট একটি আসন বেশি পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। হারলেও পূর্বের ন্যায় সিনেটের নিয়ন্ত্রন তাদের হাতেই থাকবে। শুধু তাই নয় ষ্ট্যাট গভর্নরের পদে সাধারণত মোট ভোট কম পেয়েও ছোট ছোট রেড ষ্ট্যাটের কারনে বরাবরই রিপাবলিকান দল বেশি সংখ্যক ষ্ট্যাটে গভর্নর পদে জিতে, কিন্ত এবার ডেমোক্র্যাট অনেক গুলো গভর্নর পদও ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এবারে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রায় সমান সমান গভর্নর পদ দখলে নিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট ষ্ট্যাট সমূহ বড় বিধায় তাদের ভোটের সংখ্যাও এবার পূর্বের তুলনায় বেডেছে। ষ্ট্যাটের অন্যান্য পদের নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাট পূর্বের তুলনায় অনেক ভালো করেছে। বিগত একশ বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইতিহাসে মাত্র তিনবার তিনজন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। ১৯৩৫ সালে ফ্রেডরিক ডি রুজভেল্ট (এফ ডি আর), পন্চাশ এর দশকে জন এফ কেনেডি ও আশির দশকে সিনিয়র বুশের বেলায়। তাই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ বলছেন যে, জো বাইডেনকে যতটুকু না দূর্বল প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করা হোক না কেন, আসলে তিনি তার চেয়েও আরও অনেক শক্তিশালী ও প্রাজ্ঞ্য।

এ নির্বাচনে ১০০ সিনেট আসনের মধ্যে ৩৫ আসন এবং হাইজের ৪৩৫ আসনের সবকটিতেই নির্বাচন অনুষ্টিত হল। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা মোতাবেক বিরোধীদল হিসেবে রিপাবলিকানদের এ নির্বাচনের সবশেষ ফলাফলের পর সিনেটে অন্তত ৫১ থেকে ৫২ আসন ও হাউজে ২৩০ থেকে ২৪০ আসন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্ত সংগত কারনে তা হয়নি। সে ক্ষেত্রে সিনেটে তারা পূর্বের নিজেদের একটি আসন হারিয়েছে। হাউজে বড়জোর চার থেকে পাঁচটি আসন বেশি পেতেও পারে আবার মাত্র ২ থেকে ৩ টি আসনও বেশি পেতে পারে। সর্বশেষ ফলাফল মোতাবেক রিপাবলিকান ২১৮ ও ডেমোক্র্যাট ২১২ আসন ও বাকী ৫টি আসনের অসম্পূর্ণ গননানুযায়ী তিনটিতে ডেমোক্র্যাট ও ২ টিতে রিপাবলিকানরা এগিয়ে আছে। এদিকে হাউজে ২১৮ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে রিপাবলিকান হাউজ ককাস ইতিমধ্যেই কেভিন ম্যাকার্থীকে স্পীকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জানুয়ারীতেই নুতন কংগ্রেসের কার্যক্রম শুরু হবে। তারা ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ইম্পীচ, হোমল্যান্ড সিরিউরিটি মন্ত্রিসহ , বাইডেন পুত্র হান্টার বাইডেন, বর্ডার সিকিউর্টির কার্যক্রম, কভিড ভ্যাক্সিন মেন্ডেট ইত্যাদি বিষয়ে কংগ্রেশনাল ওভারসাইট কমিটি তদন্তের কার্যক্রম নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের তথা বাইডেন প্রশাসনের ব্যার্থতা, ত্রুটি বিচ্যুতি জনগনের সামনে তুলে ধরে নিজেদের ভোটকে সমুন্নত করতে ও জনগনকে নিজেদের পক্ষে নেবার কৌশল হিসেবেই এসব পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে। ঠিক যেমনটি করে ডেমোক্র্যাটরা এ নির্বাচনে সুফল পেয়েছে।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে রিপাবলিকান দলের ট্রাম্প অনুসারীদের নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা, কংগ্রেস ভবন তথা ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলা, মামলা, ভয় ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন কার্যক্রম নিয়ে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করে নির্বাচন বিষয়ে সাধারন জনগনের মনে সন্দেহ তৈরি করা, রিপাবলিকান দলীয় ষ্ট্যাট সমূহের ভোট প্রক্রিয়া ও ভোট দানে বিভিন্ন নুতন আইন তৈরি করে, প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা বৃদ্ধি করা, পেন্ডামিক ও পরবর্তি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে অর্থনৈতিক চাপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রসহ দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে চরম অব্যাবস্হাপনাসহ , বিভিন্ন কারনে ধারনা করা হয়েছিল যে, এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের চরম ভরাডুবি ঘটবে। মূলত তা না ঘটে, বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

উল্লেখ্য যে, এবারের নির্বাচনে ডেমেক্র্যাট দলীয় অনেক প্রার্থীদের পক্ষে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মাঠে নামেন। ওপর পক্ষে রিপাবলিকানদের পক্ষে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারা কাজ করেন। এটিও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, রিপাবলিকান দলের প্রাইমারি নির্বাচনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পক্ষের তথা ২০২০ সালের নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যানকারীদের জিতিয়ে আনতে সক্ষম হোন, এবং এটিই দলের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। এসব প্রার্থীদের অল্পকজন বাদে অধিকাংশই পরাজিত হয়। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, জনগন এমনকি রিপাবলিকান দলীয় ভোটারদের অনেকেই ট্রাম্পের উগ্র সমর্থক, ক্যাপিটল হিল আক্রমণকারী, নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান কারী, হোয়াইট বয়েজ, রেসিস্ট, ও কিউআননদের অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্হান গ্রহন করেন। যদিও অধিকাংশ রিপাবলিকান দলীয় নীতি নির্ধারক ও সিনিয়র নেতৃত্ব এতদিন ট্রাম্পের এসব সমর্থকদের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করত। কেবল সিনেট মাইনরিটি লিডার মিচ ম্যাকনাল, প্রভাবশালী নেত্রী লিজ চেনী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনিসহ অল্পকজনই বরাবরই দলকে এদের থেকে মুক্ত রাখতে বলেযাচ্ছিলেন।

শুরুতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যে বিষয়টি বলছিলাম তার প্রথম এবং অন্যতম বিষয় হলো, রিপাবলিকান দলে ট্রাম্পিজমের পতন ঘন্টা শুরু হয়েছে বলেই অনেকের ধারনা। দলের ভিতরে ভিতরে প্রভাবশালী নীতি নির্ধারনী ও নেতৃত্ব অনেক পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ৬ জানুয়ারীর পর থেকেই সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সম্প্রতি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্স মাইক পেন্স তার সি এন এন টাউন হল সাক্ষাতকারে নিজের প্রার্থীতা বিষয়ে কিছু না বলে, স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, দল ট্রাম্পের চেয়েও আরও ভাল প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্যে কাজ করে যাচ্ছে।

অপরদিকে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই নিজে নিজেই তার প্রার্থীতা ঘোষনা করে মিলিয়ন ডলারের নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করে দিয়েছেন। এতে দলের সিনিয়র জুনিয়রসহ অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন। কেননা নীতি নির্ধারনীদের অনেকেই, এবং তার অতি ঘনিষ্টজনেরা যারা বিগত দিনে, দুদুবার অভিশংসন প্রক্রিয়া, এমনকি ৬ জানুয়ারীসহ কংগ্রেসশনাল কমিটি কর্তৃক পরবর্তি সময়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও তাকে বিচারের সন্মুখীন করার সকল কর্মকান্ডের সময়ও তার পক্ষে কাজ করেছেন এমন অনেকেই এখন তার প্রকাশ্য বিরোধিতা করছেন। সাউথ কেরোলিনার সিনেটর তারই অতি ঘনিষ্টজন লিনডজি গ্রাহামসহ সিনেটর যশ হোলি তাকে আপাতত প্রার্থী ঘোষনা থেকে বিরত রাখতে অনুরোধ করলেও কোন কাজে আসেনি। অনেকেই বলছেন যে, নির্বাচনে তার পক্ষের লোকজনের পরাজয়ে, তিনি অনেকটা দূর্বল হয়ে, একাকীত্ব অনুভব করছেন এবং নিজেকে আলোচনায় রাখতে তড়িঘড়ি করে প্রাথীতা ঘোষনা করেন। রিপাবলিকান নীতি নির্ধারনকারীরা অনেকটা নিশ্চিত যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনা খুবই দূরহ হবে বৈকি।

রাজনৈতিক আবহ পরিবর্তনের দ্বিতীয় বিষয়টি হলো দুদলেই নুতন ও অপেক্ষাকৃত তরুন নেতৃত্ব সৃষ্টি ও এগিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অনুরোধ স্বত্বেও স্পীকার নেন্সী পেলসী দলের হাঊজে ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতৃত্বে না থাকার ঘোষনা দিয়ে, তরুন ও নুতন নেতা নির্বাচনের ঘোষনা দিয়েছেন। দলের অন্যান্য সিনিয়র হাউজ নেতাগণ যেমন, কংগ্রেসম্যান ওভারসাইট ককাসের প্রধান হয়য়ার, জেফরি স্মিথ ও ক্লেবার্নসহ সিনিয়র নেতৃত্ব নিজেদের পদ থেকে সরে গিয়ে সাধারন সদস্য হিসেবে থাকার ঘোষনা দিয়ে নতুন ও তরুন নেতৃত্ব সৃষ্টির আহবান জানিয়েছেন। তাই ডেমোক্র্যট হাঊজ নেতা হিসেবে নিউইয়র্কের তরুন কংগ্রেস সদস্য হাকিম জেফরির নাম জোরে শোরেই আসছে।

এদিকে রিপাবলিকান দলের ফ্লোরিডা অংগরাজ্যের ২য় বারের মত বিপূল ভোটে নির্বাচিত গভর্নর অপেক্ষাকৃত তরুন রন ডিসেন্টিসের নাম ২০২৪ সালের নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে জোরে সোরে শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি তার বিজয় ভাষনে ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করেই ট্রাম্পের তড়িঘড়ি প্রার্থীতা ঘোষনার সমালোচনা ও উপহাস করেন। রিপাবলিকান শিবিরে সিনেটর জোশ হোলিসহ তিনিও ট্রাম্প পন্হি বলে পরিচিত থাকলেও, এখন ট্রাম্পের বিপক্ষে সরাসরি কথা বলছেন। এদিকে ট্রাম্পপন্হি মিডিয়া ফক্স নিউজও তার প্রার্থীতা ঘোষনা নিয়ে সমালোচনা করছে। রিপাবলিকানপন্হি ডেইলি পোষ্ট উপহাস করে প্রথম পাতার একদম নীচে ছোট কলামে “ফ্লোরিডা ম্যান তার প্রার্থীতা ঘোষনা করেছে” শিরোনামে নিউজ ছেপেছে।

ডেমোক্র্যাট দলে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত কোন নতুন বা তরুন নাম শোনা না গেলেও সময়ে উচ্চারিত হলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। কেননা বিজ্ঞ মহল বলছেন বাইডেন দেশ ও দলের জন্য যে কোন রকম ত্যাগ স্বীকারে সব সময় প্রস্তুত।