আন্তন চেখভ: ছোটগল্পে জীবনের নিভৃততম অংশের রূপকার

179

আধুনিক ছোটগল্পের ওস্তাদদের কথা উঠলে তিনটি নাম অবধারিতভাবে আসতে বাধ্য- গি দ্য মপাসাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আন্তন চেখভ। তিনটি নামই বাঙালির পরিচিত, তিনের লেখাই আজ বহু দশক ধরে একইভাবে সমাদৃত ও বহুল পঠিত। 

ভ্রু কুঁচকাবেন না। ফরাসি, বাঙালি আর রুশ এই তিন ভদ্রলোক বাদেও বহু দুর্দান্ত লেখক বহু সরস ছোটগল্প লিখে গিয়েছেন। কিন্তু ভাষাবিদ ও পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, এদের শ্রেষ্ঠত্ব লেখার মডেলগুলোর কল্যাণে। এই তিন স্রষ্টাই আপনা মডেলের ছোটগল্প লিখেছেন, বাকি তাবত লেখকেরা সে মডেল মেনে উৎকৃষ্ট গল্প লিখেছেন বটে, কিন্তু নিজস্ব মডেল ক’জন সার্থকভাবে বানাতে পেরেছেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। 

যা-ই হোক, সীমিত পরিসরে এই ত্রয়ীর তূলনামূলক আলোচনার দুঃসাহস না দেখানোই ভালো। আজকের আলোচনা তাই আন্তন চেখভকে নিয়ে। তাও শুধুমাত্র তার ছোটগল্প নিয়ে। 

জীবন

আন্তন পাভলোভিচ চেখভের জন্ম ১৮৬০ সালে, দক্ষিণ রাশিয়ায়, আজভ সাগরের তীরে। পিতা রুশ, মাতা ইউক্রেনীয়। দেনাগ্রস্ত পিতা ছিলেন বদরাগী, পান থেকে চুন খসলে আড়ং ধোলাই দিতেন, মা আবার সুন্দর গল্প বলতেন। পাওনাদারের ভয়ে পরিবারটি একসময় মস্কোতে পালিয়ে যায়। কিশোর চেখভ ছাত্র পড়িয়ে, সস্তা লেখা লিখে কোনোমতে খরচ চালিয়ে নিতেন। অল্প বয়সেই প্রতিভাধর লেখক হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ে।  

মস্কোতে চেখভ পড়েন ডাক্তারি। রাশিয়ায় কলেরা মহামারি দেখা দেওয়ায় বছরখানেক কষে ডাক্তারি করেন, কিন্তু ঐ পেশার মেহনত চেখভের দুর্বল শরীরে সয়নি। তাছাড়া ততদিনে লেখক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বাকি জীবনটা কলম চালিয়েই পার করেন। মাঝে ছোট একটা ভূ-সম্পত্তি কিনে বছর কয়েক গ্রামে বসবাস করেছেন।

ডাক্তারির পড়ার পর পরই আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। সারাজীবন এ রোগ তাকে ভুগিয়েছে। খ্যাতির গগনে উঠেছেন নাটক আর ছোটগল্প লিখে, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা পিছু ছাড়েনি। শেষ জীবনে, ১৯০১ সালে ওলগা নীপার নাম্নী এক রূপসী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেন। ঠিক গতানুগতিক বিবাহিত জীবন তার ছিল না। স্ত্রী অভিনয়ের পাশাপাশি চেখভের সেবাযত্ন করতেন। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই মহান লেখক ইহজগৎ ত্যাগ করেন। 

চেখভের স্টাইল

চেখভ লিখেছেন খুব অল্প। কিন্তু তারপরেও তার ছোটগল্পের এত সুনাম কেন? তার স্টাইলটাই বা কী, যা তাকে স্বতন্ত্র করেছে? একটু তুলনা টানা যাক। পৃথিবীতে সবথেকে প্রচলিত ছোটগল্পের মডেলটি সম্ভবত মপাসাঁর। সংক্ষেপে, মপাসাঁর গল্পের শেষে একটা ক্লাইম্যাক্স থাকে। সমস্ত বর্ণনা, কীর্তিকাহিনী গল্পটাকে সেই ক্লাইম্যাক্সের দিকে নিয়ে যায়। হরে-দরে এটাই ছোটগল্পের জনপ্রিয়তম পন্থা। আমাদের রবিঠাকুর নিজেও এই মডেলে প্রচুর গল্প লিখেছেন। কিন্তু ঠাকুরের গল্পের আসল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাধারণ কাব্য বা গীতিরস, ছোটগল্পে এহেন রসের সার্থক প্রয়োগের কারণেই রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব স্টাইল দাঁড় করতে পেরেছেন। 

এক্ষেত্রে চেখভের কৃতিত্ব? ক্লাইম্যাক্সবিহীন গল্প। নিস্তরঙ্গ, কিন্তু একইসাথে প্রচণ্ড বাস্তবমুখী সমস্যার গল্প। বস্তুত আমাদের জীবনে ক্লাইম্যাক্স আর কতখানিই বা আছে? বেশিরভাগ ঘটনাই তো সাদামাটা, বিশেষত্বহীন। চেখভের মুন্সিয়ানা হচ্ছে এই সাদামাটা, বিশেষত্বহীন জীবনকেই ছোটগল্পে স্থান দেওয়া। কোনো ক্লাইম্যাক্স ছাড়াই সার্থক ছোটগল্প। অবশ্য এর ব্যত্যয়ও দেখা যায়। কিন্তু চেখভের ক্লাইম্যাক্স তার গল্পের মতোই জীবনমুখী ও স্বাভাবিক। পড়ে চমক লাগে না, অথচ গল্পটিও অসাধারণ থাকে।

আরেকটি অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য আছে চেখভের, যা তাকে খোদ তলস্তয়ের কাছ থেকেও অকৃপণ প্রশংসা এনে দিয়েছে। চেখভের চরিত্রগুলো নিজেই গল্প বলে। লেখকের উপস্থিতি ঢাকা পড়ে চরিত্রগুলোর নিখুঁত জীবন্ত আচরণে। চেখভের বিখ্যাত ছোটগল্পগুলো পড়লে মনে হয়, চরিত্রগুলো জীবন্ত, সেখানে লেখকের কল্পনাশক্তির কোনো ছাপ নেই; বাস্তবে বরং এমনটাই ঘটে থাকে। ব্যক্তি চরিত্র (এক্ষেত্রে লেখক চরিত্র) এর ঊর্ধ্বে উঠে চরিতায়নের এই অস্বাভাবিক ও একইসাথে অসাধারণ কাজটি সুনিপুণভাবে করে দেখিয়েছেন চেখভ। 

চেখভের বন্দুক

ধরা যাক, একটা ছোটগল্পের শুরুতে কোনো ঘরের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। লেখক মশাই একথা-সেকথার ফাঁকে জানালেন, ঘরের এক দেওয়ালে একটা বন্দুক ঝুলছে। চেখভের বক্তব্য হল, দেওয়ালে বন্দুক ঝোলালে অবশ্যই ঐ বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়তে হবে বা কোনো প্রাসঙ্গিকতা বা ব্যবহার দেখাতে হবে। নাহলে শুরুতে দেওয়ালে বন্দুক ঝোলাবার কোনো প্রয়োজন নেই। 

এর মর্মার্থ হলো, চেখভের মতে, কোনো গল্পে যা বিবরণ দেওয়া হবে, তার সমস্ত উপাদান কোনো না কোনো কাজে লাগাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা বিবরণ গল্পের গুনমানকে হ্রাস করে। চেখভ নিজের গল্পে এই অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেঁটে ফেলার ব্যাপারে গুরুতর মনোনিবেশ করেছেন।

বিখ্যাত কিছু ছোটগল্পের নির্যাস

চেখভের কয়েকটি বিখ্যাত ছোটগল্প কেটেকুটে দেখা যাক; তাহলে তার লেখা নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে-

‘কুকুরসঙ্গী মহিলা’কে সর্বকালের সেরা ছোটগল্পগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। ব্যবসায়ী গুরভ মানুষটি নটবর। ছুটিতে তার সাথে দেখা হয় আন্না নাম্নী জনৈকা বিবাহিতার। তারপর যা হওয়ার তা-ই, জমে উঠল রোমান্স। ছুটি শেষে দেখা যাচ্ছে বহু নারীসঙ্গে অভ্যস্ত গুরভের মনে আন্না জাগিয়ে তুলেছে সত্যিকারের প্রেম। নিজের বুদ্ধিজীবী স্ত্রীকে এড়িয়ে সে ছুটে গেল আন্নার কাছে, অথচ সেও বিবাহিতা। সস্তা হোটেলের ঘরে দুই প্রণয়ী বসে, চেখভের ভাষায়-

“দুজনের মনে হলো, একটা কিছু সিদ্ধান্ত প্রায় তাদের নাগালের মধ্যে এসে গেছে, সেটা ধরতে পারলেই শুরু হবে নতুন ও সুন্দর জীবন। দু’জনেই বুঝেছে যে, শেষ এখনো দূরে, অনেক অনেক দূরে, সবথেকে শক্ত আর জটিল অংশটির সবে সূত্রপাত হয়েছে।”

এবং এখানেই গল্পের শেষ। গোটা প্লট জুড়েই এই রোমান্স এবং শেষদিকে প্রবল সাসপেন্সে এসে গল্পটা চেখভ ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের কল্পনার হাতে। আপাত অসম্পূর্ণ, কিন্তু অসাধারণ পরিপূর্ণ এ গল্প। 

কিংবা ধরা যাক ‘চুম্বন’ গল্পটির কথা। সাদামাটা কসাক অফিসারকে নেমন্তন্ন দিয়েছেন কাউন্ট। কাউন্টের বাসায় পথ হারিয়ে সে ঢুকল অন্ধকার এক ঘরে। সেখানে অন্য কারো জন্য অপেক্ষারতা এক রমণীর বাহুপাশে পেল একটি চুম্বন। মেয়েটি ভুল বুঝে পালাল, কিন্তু অফিসারের মন তখন পাখা মেলেছে। নাচের আসরের প্রত্যেকটি মেয়েকে সে খুঁটিয়ে দেখে, খোঁজে, আর ছাউনিতে ফেরার পরেও তার মাথায় কেবলই ঘোরে সেই মেয়ের কথা। কিছুদিন বাদে সে যখন বুঝল, তার এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা কেবলই এক ভুল বোঝাবুঝি, তার তাসের কেল্লা ভেঙে পড়ল এক লহমায়। পরেরবার কাউন্টের নেমন্তন্ন এলে সে স্রেফ হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ল। 

মানব জীবনের নিস্তরঙ্গতায় বিরক্ত হয়ে ফাটকার নেশায় যারাই উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, চেখভের গল্পে তাদের সবার পরিণতি কমবেশি এক; আশাহত ও পরাভূত। বাস্তব জীবনের যা নিয়ম, সেটাই ক্লাইম্যাক্সবিহীন গল্পে বারবার উপস্থিত হয়েছে। ‘কনে’ গল্পের নাদিয়া বিয়ের আগমুহূর্তে রোমাঞ্চকর আর অর্থপূর্ণ জীবনের লোভে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি ছেড়ে, ঠিক যেমনটি করেছিল ‘একটি বিরস গল্পে’র কাতিয়া। নাদিয়া আর কাতিয়া দু’জনেই বিস্তর ঘুরে শেষমেষ হতাশ হয়ে ফেরত আসে। ভোগে পরিপূর্ণ, ঝলমলে জীবনের অতৃপ্তি তাদের ধাওয়া করে।

নাদিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যার মন্ত্রণায় সে ঘর ছেড়েছিল সেই সাশা নিজেই জীবনের চাপে পর্যুদস্ত, আর কাতিয়াকে যিনি থিতু হয়ে বসার সদুপদেশ দিয়েছিলেন, সেই বৃদ্ধ নিকোলাই স্তেপানোভিচ দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েও থিতু জীবনের ক্লান্তিতে হয়েছেন বিরস আর বিরক্ত। প্রায় একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ওলগাকে। ‘প্রজাপতি’ গল্পের নায়িকা স্বামীকে ভুলে ছুটেছেন প্রতিভাবান চিত্রকরের নেশায়, পরে ভয়ানক আশাহত হয়ে ফিরে দেখেন, তার স্বামীর মধ্যেই ছিল সেই মহান মানুষটি, অথচ লোকটির তখন শেষ সময়, মৃত্যু সন্নিকটে। 

কিংবা ধরা যাক ‘গুজবেরি’ গল্পের সেই কেরানির কথা। একজন হাড়কেপ্পন, তার সমুদয় জীবনের সাধ-স্বপ্ন হচ্ছে একটি; সে নিজের জমির গুজবেরি ফল খাবে। আর এ স্বপ্ন যত তুচ্ছই হোক, তার পেছনে লেগে পড়ে চাকরিজীবনের শুরু থেকে। ফলাফল? এক নোংরা আর শ্রীহীন ছোট্ট জমিদারি বাগিয়ে সে গাদাখানেক গুজবেরির ঝোপ লাগায়, আর সুখী বোধ করতে থাকে সেই ফল খেয়ে, যদিও স্বাদে তা ‘শক্ত ও টক’। আর এই যে নিজের স্বপ্নপূরণে ব্যগ্রতা? গল্পের একটি চরিত্রের ভাষায়, 

“চোখের সামনে দেখলাম সত্যিকারের সুখী একটি মানুষ, যার প্রিয়তম আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে, যে জীবনের লক্ষ্য সাধন করেছে; যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে, পেয়ে নিজের বরাত নিয়ে আর নিজেকে নিয়ে তৃপ্তি লাভ করেছে।”

আর এই সুখী লোকের কথা ভাবতে গিয়েই তার উপলব্ধি,

“ক’জন লোকই বা সুখী? জীবনের ভয়ংকর ব্যাপারগুলো সর্বদাই ঘটে দৃশ্যের অন্তরালে।”

বস্তুত, আন্তন চেখভের গল্পের বিশেষত্বই হচ্ছে, অন্তরালের এই মানসিকতাকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা করা। সুখ, দুঃখ, আশা, হাস্যরস, হঠকারিতা মানুষের জীবনে যে ভাবে আরো দশটা ঘটনার মতো প্রতিভাত হয়, সেই সাদামাটা, সার্বজনীন জীবনধারার স্বাভাবিক অথচ প্রায় অদৃশ্য স্রোত তুলে ধরার ক্ষমতা চেখভের ছোটগল্পগুলোকে অমরত্ব দিয়েছে।  

চেখভ পেশায় ডাক্তার ছিলেন, তার গল্পে ডাক্তার কিংবা ডাক্তারি শাস্ত্রের অধ্যাপকেরা এসেছেন ঘুরেফিরে। বিখ্যাত ‘৬ নং ওয়ার্ড’ গল্পে দেখা মেলে এমন এক ডাক্তারের। জীবন সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার নেশায় আবিষ্কার করেন, একটিমাত্র লোকের সাথেই আলোচনা করে সুখ আছে। আদালতের সেই প্রাক্তন কর্মচারী স্বাধীনতা ও সম্মান খোয়া যাওয়ার আতঙ্কে হয়ে গিয়েছেন পাগল। তাদের আলাপের ফলাফল? সুস্থ ডাক্তারটিকেও ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে পুরে দেওয়া হয় পাগলাগারদে। ডাক্তারের ভাষায়, 

“আমার ভুল এই যে, গত বিশ বছরের মধ্যে একজন মাত্র বুদ্ধিমান লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছে এবং সেই লোকটি পাগল। আমি বিন্দুমাত্র অসুস্থ নেই, আমি শুধু একটা পাপচক্রের মধ্যে আটকা পড়েছি, আমার পরিত্রাণ নেই।”

সমাজের গোপন পাপচক্র, গুমোট অবস্থায় পড়ে ছটফট করা মানুষ; তাদের ভয়, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা, ভড়ং, তোষামোদি, মৃত্যুর আতঙ্ক, একঘেয়েমি আর হঠকারিতা নিয়ে বারবার ফিরে এসেছে চেখভের চরিত্ররূপে। তার ভাষায়,

“ভাবতে গেলে বাস্তবিকই পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর, শুধু আমাদের চিন্তা ও আচরণ ছাড়া, যখন আমরা ভুলে যাই জীবনের উন্নততর উদ্দেশ্য আর মানুষ হিসেবে আমাদের মর্যাদাবোধের কথা।”

১৯০৪ সালে আন্তন পাভলোভিচ চেখভের মৃত্যু হয়। লেখকদের মহাগুরু তলস্তয় বলেছিলেন, “চেখভ মেয়ে হলে ওকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিতাম”