নীনা আহমেদ: এক অনন্য ব্যক্তিত্ব
ড. নীনা আহমেদ পেনসিলভানিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পদে নির্বাচন লড়তে তৈরি হয়েছেন। অনেকে আশ্চর্য হলেও আমার কাছে এটি একটি শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। ফিলাডেলফিয়ায় নীনাকে ও তাঁর স্বামী কমলকে চিনি সেই ১৯৮৬ সাল থেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছয় মাস পড়ার পর পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেই তরুণ বয়সে শুরু করেন নিজের স্বপ্নকে বাস্তব করার সংগ্রাম। পড়াশোনা শুধু চালিয়ে যাননি তিনি, আমেরিকার প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি শেষ করে পৃথিবীর প্রথম এবং প্রখ্যাত ‘উইলস আই’ চক্ষু হাসপাতাল রিসার্চে আত্মনিয়োগ করেন। সেখান থেকে রিসার্চে বেশ কিছু উদ্ভাবন করে সুনাম অর্জন করেন।
ফিলাডেলফিয়া শহরে অনেক গরিব মানুষের দুর্দশা দেখে চিকিৎসাশাস্ত্রে মানুষের সেবা করার পরিবর্তে সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য আমেরিকার রাজনীতিতে প্রবেশ করা মনস্থ করেন নীনা। ধীরে ধীরে ফিলাডেলফিয়ার ডেমোক্রেটিক পার্টির উঁচু কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন এবং সবার আস্থা ও শ্রদ্ধা লাভ করেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে ভারমন্ট স্টেটের গভর্নর ডা. হাওয়ার্ড ডিন ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পদপ্রার্থী হলে নীনা আহমেদ তাঁর নির্বাচনী প্রচারে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশি মেয়ে নীনা আহমেদের এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশিরাও তখন নীনা আহমেদের পক্ষে ১০টা হাউস পার্টি করে তাঁকে সমর্থন জানাই। নীনা এরপর থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে আরও তৎপর হন। তাঁর স্বামী কোমল ততক্ষণে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় উন্নতি করেছেন এবং নীনাকে সর্বাত্মক সাহায্য করার সংকল্প করেন। একজন বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, সাহসী, সাবলীল, সুবক্তা, সাহায্যকারী ও বিত্তবান অভিবাসী নারী ফিলাডেলফিয়ার রাজনীতিতে নিয়ে আসেন এক আশার ঝিলিক। ফিলাডেলফিয়ার মেয়র তাঁকে এশিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন, একই সময়ে ফিলাডেলফিয়া চ্যাপ্টারে আমেরিকার জাতীয় নারী সমিতিরও সভাপতি নির্বাচিত হন।
আমার মাঝে মাঝে তাঁর এশিয়ান আমেরিকান কাউন্সিল মিটিংয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। অবাক হয়ে দেখেছি, আমি শুধু একমাত্র বাংলাদেশি। হল-ভর্তি অন্যান্য গোত্র ও বর্ণনির্বিশেষে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ তাঁকে কি গভীরভাবে সম্মান করেন এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখেন। কারোর অসুবিধা শুনে তাঁকে কোনো দিন বসে থাকতে দেখিনি। কোনো দিন চায়না টাউনে, কোনো দিন নেপালি এলাকায়, তাঁর বিরামহীন ছুটে যাওয়া। বাংলাদেশিদের প্রাণের দাবি ছিল ফিলাডেলফিয়া আর্ট মিউজিয়ামের সামনে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হেরিটেজ পার্কওয়েতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। বহু বছরের সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবায়ন করার জন্য নীনা সিটির সব কাউন্সিল মেম্বারের সঙ্গে বৈঠক করতে লাগলেন। তাঁর নিজস্ব উদ্যোগে তাই আজ সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আবার হঠাৎ শহরের এক মসজিদের সামনে নতুন মদের দোকান বন্ধের জন্য মুসল্লিদের অনুরোধে নীনা মসজিদের সামনে এসে রাতে সবার সঙ্গে শক্ত ভাষায় প্রতিবাদ শুরু করেন। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডরের অনুরোধে কংগ্রেসে গার্মেন্টস-সংক্রান্ত একটি বিল নিয়ে নীনা পেনসিলভানিয়ার সিনেটরের সঙ্গে দেখা করে তার পক্ষে যুক্তিতর্ক করেন। বাংলাদেশি পুরুষ ও নারীদের তিনি ফিলাডেলফিয়ার সিটির বিভিন্ন কমিটিতে ঢোকালেন। মেয়েদের সামনে আসার জন্য উৎসাহী করতে লাগলেন। কোনো অনুরোধই তাঁর কাছে ছোট মনে হতো না।
পরবর্তী পর্যায়ে ওবামার নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্ব ছিল অসাধারণ। প্রেসিডেন্ট ওবামা নীনা আহমেদকে তাঁর শক্তিশালী এশিয়ান আমেরিকান ও প্যাসিফিক আইল্যান্ডের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য নির্বাচন করেন। সেই কমিটির সব সদস্যের মাঝে বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ডাক পড়ত নীনা আহমেদের। এর মধ্যে ফিলাডেলফিয়ার মেয়র নির্বাচনে নতুন মেয়র জিম কেইনির বিজয়ী হওয়ার পেছনে নীনা আহমেদের পরিশ্রম ও পরামর্শ অত্যন্ত ফল লাভ করে। নীনার অনুরোধে সেই সময় বাংলাদেশি কমিউনিটি অত্যন্ত সক্রিয় হয় এবং নতুন মেয়রের কাছ থেকে প্রচুর প্রশংসা লাভ করে। মেয়র কেইনি নীনা আহমেদকে ফিলাডেলফিয়ার ডেপুটি মেয়র পদে নিযুক্ত করেন এবং তাঁর হাতে অনেক দায়িত্ব প্রদান করেন। অনেক পরিশ্রম করে শহরের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার জন্য নীনা সক্রিয় হন এবং প্রশংসা লাভ করেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং সমাজের অবক্ষয় তাঁকে সামনে এগিয়ে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ফিলাডেলফিয়ার ২০ বছরের কংগ্রেসম্যান ব্র্যাডিকে দুর্নীতির জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে অযোগ্য ঘোষণা করলে পার্টির বেশির ভাগ লোক তাঁকে সেই পদে কংগ্রেসে লড়ার জন্য উৎসাহিত করেন। নীনা আহমেদ তখন ডেপুটি মেয়রের পদে ইস্তফা দিয়ে প্রার্থী হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্বাচনী এলাকা বিলুপ্তি করে নতুন রেখা টানেন। দমার পাত্র নন নীনা। তখনই তাঁর কাছে অনেকে পেনসিলভানিয়ার স্টেটের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করেন কারণ বর্তমান লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনেক ত্রুটির জন্য বিতর্কিত। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সাড়ে চার হাজার সই জোগাড় করে এখন ব্যালটে স্থান করে নিয়েছেন নীনা। সবচেয়ে বেশি তহবিলও রয়েছে তাঁর। তবে বিশাল পেনসিলভানিয়ার বিভিন্ন শহরে তাঁর পরিচিতির জন্য প্রয়োজন প্রচুর টেলিভিশন প্রচারাভিযান এবং অর্থের। পেনসিলভানিয়ার প্রাইমারি ইলেকশন আগামী ১৫ মে। এত কম সময়ে তিনি বিভিন্ন শহরে বেশ কিছু বাংলাদেশির উৎসাহের সঙ্গে তহবিল সংগ্রহে এগিয়ে আসছেন। প্রথমবারের মতো একজন সুযোগ্য বাংলাদেশি, সমাজসেবক, অভিজ্ঞ, পার্টির সম্মানিত, নামী বিজ্ঞানী; যিনি শুধু নিজের বহুদিনের কর্মতৎপরতায় ও নিজের যোগ্যতায় প্রার্থী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে নীনা আহমেদের প্রেরণা। ডেপুটি মেয়র হওয়ার পর তিনি মেয়রকে নিয়ে প্রথমবারের মতো ফিলাডেলফিয়ায় দেশি-বিদেশি ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করেন। তিনি সব সময় বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাই আমি আর কিছু ভয় পাই না। কী ভয়ংকর ছিল সেই সময়। শিশু হওয়া সত্ত্বেও আমার মা আমার চুল ছেলেদের মতো কেটে রাখত। আমি তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, এখানে যতই রাজনীতি করি না কেন, আমি বাংলাদেশকে সব সময় আপ্রাণ সাহায্য করব।’ নীনা বলেন, ‘আমি কংগ্রেসে গেলে আমি হতাম আমেরিকার কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক কংগ্রেস সদস্য। রাজনীতিতে পেশাজীবী এবং বৈজ্ঞানিক না থাকলে কংগ্রেস এবং স্টেট অনেক ভুল নীতি গ্রহণ করে। তাই আমি রাজনীতিতে, সবার জন্য চিকিৎসা, সমান শিক্ষাব্যবস্থা, দুর্নীতিহীন রাজনীতি, স্বচ্ছতা, নারীদের সম্মান, অভিবাসীদের ন্যায্য সুবিধা, এসব পরিবর্তন আনতে বর্তমান ট্রাম্প সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাই। আমাদের প্রজন্মদের জন্য আমি দ্বার খুলে দিতে চাই। আজকের আমেরিকায় আমার মতো অভিবাসী বা ধর্মের অথবা যাঁরা সাদা চামড়ার নন, তাঁদের ন্যায্য দাবি বা অধিকারের সাহস জোগাতে চাই।’
আমি জানি না বাংলাদেশি আমেরিকানদের তাঁকে সাহায্যের মাধ্যমে আমেরিকার বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রবেশ করার এই সুযোগ আর কোনো দিন আসবে কি না। তাই আমাদের সচেতনভাবে, স্বল্প সময়ে আর্থিকসহ সব রকমের সহায়তায় এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।
ড. নীনা আহমেদ, নির্বাচনী প্রচার উপদেষ্টা