সম্পা শ্রী, ওয়াশিংটন ডিসি।
উপন্যাসিক তার কল্পনায় নারী চরিত্র সৃষ্টি করেন তার শুকনো কাগজের বুকে, আর সেই শুকনো কাগজের বুকে থেকে সেই নারী যদি জীবন্ত হয়ে যায় তবে তাকে কি জাদু বলে ?সেই নারী যদি অস্তিত্ব রক্ষায় অথবা সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায় হয়ে উঠে বিপ্লবী, তাকে কি আর কাগজের নায়িকা বলা যায়? সে যেন হয়ে গেলো প্রতিটি ঘরের কন্যা।
আমি বলছিলাম উপন্যাস থেকে উঠে আসা জয়িতা,মাধবীলতা অথবা দীপাবলিদের কথা, যারা আবদ্ধ থাকার কথা ছিল শুধু সমরেশ মজুমদারের মলাটে বাঁধা উপন্যাসে, কিন্তু বাস্তবে সেটা আমি বা আমার মত হাজারো নারী জন্মাবে রক্ত বীজের মতো তা হয়তো সমরেশ মজুমদার নিজেও জানতেন না।
কলেজ পড়ার সময় সহপাঠী সুদীপ্ত বললো তোমার সাথে জয়িতার অনেক মিল। আমি তোমাকে জয়ী বলে ডাকতে পারি ? আমি তখন তাকে পাত্তা দেইনি, কিন্তু পরের দিন আমাকে উপহার দিলো সমরেশ মজুমদার (গর্ভধারিনী) উপন্যাসটি, আর বললো বইটা পড়ে দেখ মিল খুঁজে পাবে।
অসম অর্থনৈতিক কাঠামোয় বড় হয়ে ওঠা চার বন্ধু, জয়িতা, সুদীপ, আনন্দ আর কল্যাণ এর গল্প ।এই চার বন্ধুর
তাদের মধ্যে একজন নারী ছিলেন জয়িতা , এক সময় তারা উপলব্ধি করল অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে এই দেশে। কারও যেন নিজস্ব কোন দায় নেই, দেশটার ভালোমন্দের ইজারা রাজনৈতিক দলগুলির ওপর দিয়ে অধিকাংশ মানুষ ঘরের নিরাপদ কোণ খুঁজছে।
শুরু হয় জয়িতা ও তার বন্ধুদের বিপ্লবী চিন্তা ধারা ।ঘূণে ধরা সমাজের মানুষের বিবেক বোধকে নাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্য একের পর এক অভিযান চালিয়ে যায় তারা। হত্যা করে মানুষরূপী অমানুষদের। সেখানে শুরু হয় একমাত্র নারী জয়িতা তাদের দলের আত্মত্যাগ ও সাধনা।
এই গল্প তো সবারই জানা। কিন্তু এই গল্পের তরুণী বয়সে আমি নিজের মধ্যে লালন করতে শুরু করি জয়িতাকে। আর সেই সংলাপ ঘেঁথে গেল চিত্তে “পেতে হলে কিছু দিতে হয়। ত্যাগ করতে না চাইলে পাওয়ার আশা অর্থহীন। বাঙ্গালী মল মুত্র এবং বীর্য ছাড়া কিছুই ত্যাগ করতে জানে না।”আমিও একটু একটু করে টের পাচ্ছি আমি জয়িতা হয়ে উঠছি সেই ভীতু লাজুক মেয়েটা মুহূর্তেই যেন আত্মবিশ্বাসি, স্বাধীনচেতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠা এক জয়িতা হয়ে উঠলো, ঠিক আমি যেন জয়িতার হাতটা ধরলাম। যেন বহুদিন পর কোন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দেখা পেলাম।
কোন আন্দোলন শুরুর আগে টিম লাগবে তাই তৈরি হল ৫ জনের টিম নাম ছিল ” ৫ কমান্ডো” এই টিমের আমি একমাত্র নারী ছিলাম।
আমাদের পরিবারের মায়ের কাজে যিনি সহযোগিতা করতেন তার একমাত্র মেয়ে ববিতার বিয়ে, মাকে এসে বললো, “আমার মেয়ে তো কালো তাই ছেলে পক্ষ যৌতুক চেয়েছে অনেক এত টাকা কোথায় পাবো” বলে প্রায় কেঁদে দিলো । আমি মাত্র স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি , মন ছিল কাঁদার মত নরম তার কান্না আমাকে আঘাত করলো।
নিজের ছোট্ট মনের সাথে যুদ্ধ শুরু হলো কেন যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে এই সমাজ এমন কেন ইত্যাদি ইত্যাদি ?৫ কমান্ডো’র সবাইকে বললাম কথাটা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলেটা সুদীপ্ত বললো, এই আন্দোলন অশিক্ষিত বা নিন্মবিত্ত থেকে শুরু করা যাবে না এই আন্দোলনের ফসল নিন্মবিত্তের মানুষ পাবে সেই ভাবে আমরা আগাবো । কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটার বিয়েতে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। ৫ জন মিলে প্রথম শিক্ষকদের কাছে অভিনব বক্তব্য রাখলাম ,আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেব কাঠখোট্টা এবং চিরকুমার,খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু প্রেক্ষাপট ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, “মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিলাম” তার পর বাকি বন্ধুরা দুহাত ভরে দিল । সেই দিন আমরা ৫ কমান্ডো’র সবাই গিয়ে ববিতার মায়ের হাতে টাক তুলে দিয়ে বললাম, ‘আর যেন কোন ববিতার বিয়েতে যৌতুক না দিতে হয় সেই অসম সমাজ আমরা ভাঙবো’।
বাকি চার বন্ধুর কথা আমি জানি না, তবে আমি আজোও সেই অসম সমাজের দরজায় কষাঘাত করেই যাচ্ছি, কারন আমি যে জয়িতা। আমি শুকনো কাগজের বুকে থাকা নায়িকা নই, আমি বিপ্লবী সাধারন নারী।
বাস্তবের নায়িকারা কাগজের নায়িকার মত লেখকের সহযোগিতা পায়নি, আর পায়নি বলেই হয়তো আজও নিভু নিভু প্রদীপ জ্বালিয়েও ঘোর অমাবস্যাযর অন্ধকার তাড়াতে চেষ্টা চলিয়ে যাই।
এই পর্যায়ের আমার এই পর্বের অবসান ঘটলো। আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাই, হটাৎ সেই ৫কমান্ডোর সুদীপ্ত আবার ফিরে এলো সমরেশ মজুমদার গর্ভধারিনীর থেকেই কোট করে বললো,
“মেয়েরা গণেশের মত, মা দূর্গার চারপাশে পাক দিয়ে যে জগত দেখে তাতেই তৃপ্তি আর পুরুষরা কার্তিকের মত সারা পৃথিবী ঘুরে আসে অথচ কি দেখে তা তারাই জানে না।” যা জয়ী, কার্তিকের মত তুই সারা পৃথিবী ঘুরে আস আর নিজেকে বিলিয়ে দে আলোর সন্ধানে । আর আজ জয়ীতা থেকে এইবার দীপাবলিতে নিজেকে বিসর্জন দে’ এই বলে উপহার দিলো সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস “সাতকাহন” ।
সাতকাহন উপন্যাসটিতে সেই সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান এবং পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে এক যোদ্ধার নারীর গল্প।
যে গল্প হাজারও মেয়েকে শুধু বাঁচতে শেখায়নি,শিখিয়েছে জীবনবোধ ,আপোষহীন-সংগ্রামী করে এক নারীকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ।
এই গল্পে দীপার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য আর তা নিজের রূপ লাবণ্য কে পুঁজি করে নয়, বরং নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করেছেন সাফল্য। কিন্তু সাফল্য অর্জনের এই পথ তখন অথবা এখন কখনোই সহজ ছিল না।
সেই বহুবছর আগে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে বড় হওয়া জলপাইগুড়ির চা বাগানের কিশোরীর আর আজকের আমি বা আধুনিক দিপারা কি পৃথিবীর শ্রেষ্টতম স্থানে থেকেও নারী পুরুষের সমতা উপলব্ধি করতে পেরেছি? যদিও সেই সময় দীপা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে
একজন নারী যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম না, হয়তো তার প্রতি লেখক সুপ্রসন্ন ছিলেন বলে ।
অনেকে রস মাখিয়ে এখনো বলেন মেয়েদেরও আজকাল নাকি মানুষ হওয়ার সাধ জাগে।
মেয়েদের মানুষ হয়ে ও শুধু মেয়ে মানুষ হয়েই সন্তুষ্ট হতে হয়েছে আর মানুষ হওয়ার লড়াইটা সেটা আজকের বা একদিনের নয়। যুগ যুগ ধরেই এটি চলে এসেছে, কালের বিবর্তনে এসে হয়তো কিছুটা রং পাল্টিয়েছে কিন্তু পরিবর্তিত হয়নিমোটেও।
বাংলার অধিকাংশ নারীই মত আমি ও দিপাবলীর অস্তিত্ব টের পাই নিজের মধ্যে আর তাই তো আপোষহীন ভাবে ‘হ্যাঁ’ কে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ কে ‘না’ বলতে পারি। সাতকাহন পড়তে পড়তে কি যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলাম নিজেকে, মনে হচ্ছিলো দিপাবলী সমাজের কাছে হারছে না, বরং আমি হেরে যাচ্ছি। আবার দীপারকে যখন মনোরমা বলেছিলেন”,’মাগো, জীবন হিমালয়ের চেয়ে বড়। সেখান থেকে যেটা খুঁজে নিতে চাইবে, সেটা খুঁজবে আন্তরিকভাবে।। কারও সাথে আপোষ করবিনা। আমার বয়সে কিছু খোঁজা যায়না, কিন্তু তোর বয়সটা ঠিকঠাক।”বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাতনীকে জড়িয়ে ধরিয়েছিলেন।
এই কথাগুলো শুধু তার নাতনীকে বলেননি, বলেছিলেন আমাদের সমাজের প্রতিটি নারীকে, দীপাতো শুধু বাঙালী নারীদের প্রতিনিধি ছিল মাত্র। আমার হাতে সেদিন আমার বন্ধু সুদীপ্ত বইটি তুলে দিয়ে বলেছিলো “এই উপন্যাসটা না পড়ে মরে যাইস না”।
আসলোও আমার কল্পনায় অথবা বাস্তবে এত সুন্দর চরিত্র আর দেখিনি, সেদিন বুঝতে পারলাম বাহ্যিক সৌন্দর্য বাহ্যিকভাবে ঝালকালেও ব্যাক্তিত্বহীন মানুষ উজ্জ্বলতা স্পর্শ থেকে অনেক দূরে থাকে। আমি যে মনে মনে কতবার দীপার চরিত্রে অভিনয় করেছি তা কেবলি আমার হৃদয়ের পরিচালকই জানেন।
কল্পনার জগৎ থেকে আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম কাগজের বই থেকে বের হয়ে আমি পুনরায় জন্ম নিলাম বাস্তবের জয়ি বা দীপা রূপে, আর তাই তো মানুষ হওয়ার লড়াইটা আমি এখনও চালিয়ে যাচ্ছি ।মানুষের জীবন ও মনন গঠনে শিল্প ও সাহিত্যের অবদান অন্যতম, তা আজকের এই লেখাটা না লিখতে বসলে আমি হয়তো উপলব্ধিই করতে পারতাম না ।
প্রিয় সমরেশ মজুমদার, আমি আপনার কাছে ঋণী, আমাকে আপনি ঋদ্ধ করেছেন বাস্তবের নায়িকা রূপে।
আমার ভিতরে কলি রূপে পুষ্পটিকে আপনি প্রস্ফুটিত করছেন।
“আমি নাইবা হলেম তোমার কাব্যের নায়িকা
পথ মাঝে ছড়িয়ে থাকা হীরক চূর্ণ আমি চাইনা,
চাইনা তোমার সহমর্মিতা সংগ্রামে অথবা সঙ্কটে
যদি না সেই হীরক স্থান পায় নিজ যোগ্যতায় মোর মুকুটে।