Tanvir Hossain, Dhaka, Bangladesh
আজকাল বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা খুললে দেখা যায় বিজ্ঞানীরা সংবাদ সম্মেলন করে ইলিশ মাছ, ছাগল ইত্যাদি প্রাণীর “জীবনরহস্য” উন্মোচন করার ঘোষণা দিচ্ছেন। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে, পাটের জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। তখন বলা হয়েছিল বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা পাটের “জীবনরহস্য” উন্মোচন করেছেন। জিনোম সিকোয়েন্স করাকে বাংলায় “জীবনরহস্য” উন্মোচন বলা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
আসুন জিনোম সিকোয়েন্স ব্যাপারটা কি একটু খোলাসা করে দেখা যাক। জিনোম বলতে কোন জীবের সামগ্রিক ডি এন এ (DNA) কে বোঝায়। জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক হলো ডি এন এ অণু । এর মাধ্যমেই জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। ডি এন এ হলো ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিডের সংক্ষিপ্ত নাম।
জীবকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে ক্রোমোসমের মধ্যেই মূলত এর অবস্থান। ডি এন এ অণুগুলো বেশ বড়ো আকারের হয়। দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে এরা জড়িয়ে থাকে। তাদের এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডি এন এ ডাবল হিলিক্স। এই ডাবল হিলিক্স কাঠামোটি তৈরী হয়েছে, ডি অক্সি রাইবোস, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস (base) দিয়ে। এই বেইস গুলোর নাম হল এডেনিন (A), থায়ামিন (T), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C) । এদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে চারটি অক্ষর- ATGC দিয়ে। ডি এন এ অণুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই ডাবল হিলিক্স কাঠামোটি, যার ভেতরে A জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে, আর C জোড় বেঁধে থাকে G এর সাথে। প্রতিটি ডি এন এ অণুতে এরকম লক্ষ লক্ষ জোড়া বেইস (base pair) রয়েছে।
ডি এন এ বর্ণমালায় রয়েছে চারটি মাত্র অক্ষর ATGC। এই চারটি “অক্ষরের” বিন্যাসে এককোষী ব্যাকটেরিয়া সহ যাবতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সামগ্রিক ডি এন এ বা জিনোম গঠিত হয়েছে। জিনোমের আকার নির্ভর করে বেইসের সংখ্যার উপর। মানুষের জিনোমে প্রায় তিন বিলিয়ন বেইস পেয়ার (base pair) রয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, জিনোমের ডি এন এর পুরোটাই জিন (gene) নয়। জিন বলতে জিনোমের সেই অংশকেই বোঝায় যা নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন তৈরীর কোডকে ধারণ করে। আসলে জিনোমের অতি সামান্য অংশই হলো জিন। জিনোমের বেশির ভাগ অংশই হলো কোডবিহীন ডি এন এ। তাই জিনোমের ভেতর থেকে জিন গুলোকে রীতিমতো খুঁজে বের করতে হয়। আর এই খুঁজে বের করার কাজটি বেশ কঠিন। অনেকটা খড়ের গাদার ভেতর থেকে সুঁই খুঁজে বের করার মত ব্যাপার। মানুষের জিনোমের তিন বিলিয়ন জোড়া বেইসের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে মাত্র ২০ হাজারের মতো জিন। এই জিন গুলো সম্মিলিত ভাবে মানবের সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে।
জীব বৈচিত্র্যের মূলে রয়েছে জিনের তারতম্য। কোন জীবের সমস্ত জিনকে শনাক্ত করতে হলে প্রথমে তার পুরো জিনোমকে সিকোয়েন্স করা প্রয়োজন। জিনোম সিকোয়েন্স মানে হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডি এন এ অণুর ভেতর ATGC বেইস গুলো কিভাবে সাজানো আছে সেটা বের করা। এটা করা এক সময় খুব কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য কাজ ছিল। এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সাহায্যে এটা খুব সহজেই করা যায়। আজকাল অত্যাধুনিক সিকোয়েন্সিং
মেশিনে মোটামুটি দ্রুতই জিনোম সিকোয়েন্স করা যায়। এটা অবশ্য শতভাগ নির্ভুল নয়। ডি এন এ ডাটা তে সামান্য কিছু কিছু গ্যাপ থেকেই যায়। তবুও কাজ চালানোর মতো জিনোম সিকোয়েন্স মেশিন দিয়ে করা যায়।
কিন্তু জিনোম সিকোয়েন্স করলেই কি জীবনের রহস্য জানা হয়ে গেল? ব্যাপারটা কি এতই সহজ? আগেই বলেছি জিনোমের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশই হলো জিন। এই জিনগুলোকে শনাক্ত করার জন্য আরো কিছু কাজের প্রয়োজন রয়েছে। জিন গুলোর অবস্থান নির্ণয় করার পাশাপাশি এগুলো কি ভাবে কাজ করে, কি ধরনের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে, কিভাবে পরস্পরের সাথে ইন্টারএ্যাক্ট করে এসব জানাটাও জরুরী। এর জন্য আরো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এই গবেষণার নাম হলো ফাংশনাল জিনোমিক্স। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
জিনোম সিকোয়েন্সকে “জীবনরহস্য” উন্মোচন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটাই শেষ কথা নয়। এটা হল শুরু। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। আশা করব তাঁরা তাদের কাজ আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন।