৯ কিলোমিটারে গতিপথ বদলাচ্ছে পদ্মা

27

ইমাম হোসেন দেওয়ানের বাড়িটা ১০ বছর আগে ছিল পদ্মা থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে। ভাঙতে ভাঙতে এ বছর নদী চলে এসেছে তাঁর বসতঘরের নাকের ডগায়। এবার তিনি ভয়াবহ ভাঙন প্রত্যক্ষ করেছেন।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এ চেয়ারম্যান বললেন, ‘এ বছর আমার বাড়ির সব জায়গা বিলীন হয়ে গেছে। বসতঘরটি এখনো পদ্মার তীরে রয়েছে। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে সেটিও বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু ঘর সরিয়ে নিচ্ছি না। বাপ-দাদার স্মৃতি ছেড়ে যেতে মন চায় না।’

নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলায় পদ্মার ভাঙন নতুন নয়। তবে ইমাম হোসেনের কাহিনির আলাদা একটা অর্থ আছে। এই এলাকায় পদ্মা ক্রমান্বয়ে তার গতিপথ পাল্টে নিচ্ছে।

প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বাড়া এবং পানি কমে যাওয়ার সময় স্রোতে নদীভাঙন হয়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ওই সময়ের পাশাপাশি এখন অসময়েও ভাঙছে। এবার বর্ষা মৌসুমের আগে এপ্রিল থেকে ভাঙন শুরু হয়। আবার এই নভেম্বরে এসেও ভাঙন চলছে। নড়িয়া ও জাজিরার ৯ কিলোমিটার এলাকা ব্যাপক ভাঙন দেখা যাচ্ছে এবার।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে। এ বছর অতিমাত্রায় ও দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে পদ্মায় উজান থেকে পানির প্রবাহ ছিল বেশি। নদীতে বেশি স্রোত থাকায় ভাঙনও বেড়েছে। আবার নদীর মাঝে ও উত্তর প্রান্তে চর পড়ায় ওদিকে স্রোত নেই। মূল ধকলটা যাচ্ছে নদীর দক্ষিণ প্রান্তের নড়িয়া ও জাজিরার ওপর দিয়ে।

শরীয়তপুর পাউবো সূত্র বলছে, ১০ বছর ধরে নড়িয়া ও জাজিরায় নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। এই সময়ে উপজেলা দুটির ৯ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে পদ্মার গতিপথে পরিবর্তন হচ্ছে। সেখানে স্থানভেদে নদীটি আড়াই থেকে ৪ কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে চলতি বছরই ভেতরে প্রবেশ করেছে ৮০০ মিটার থেকে দেড় কিলোমিটার।

পাউবোর শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর প্রকৃতি খানিকটা বিরূপ আচরণ করেছে। বেশি সময় ধরে অতিবৃষ্টি হওয়ায় উজানের পানি পদ্মায় দীর্ঘ সময় ধরে স্রোত সৃষ্টি করছে।

নড়িয়া ও জাজিরার ওই ৯ কিলোমিটার অংশে স্রোত এসে সরাসরি আঘাত হানছে। এবার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে, নদীর তীরে বেশ কিছু জায়গা নিয়ে নিচের দিকে ধসে পড়ছে। নদীর তলদেশে মাটির স্তর সরে একধরনের গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় এমনটি ঘটছে। ১০ বছর যাবৎ নড়িয়া-জাজিরা এলাকায় পদ্মার গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদীর মাঝে ও অপর প্রান্তে কোনো স্রোত নেই। স্রোত হচ্ছে নদীর দক্ষিণ পাড়ে। স্রোতের আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে আসছে পদ্মা।

পাউবো জানায়, শরীয়তপুরে পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার তীর রয়েছে। এর মধ্যে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে নড়িয়ার মোক্তারেরচর, কেদারপুর, ঘড়িসার ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভা, জাজিরার কুণ্ডেরচর, বড়কান্দি ও বিলাশপুর ইউনিয়নে। এসব এলাকায় ভাঙনে এবার ৪ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। গত পাঁচ বছরে গৃহহীন হয়েছে ২৪ হাজার পরিবার। এই এলাকার মধ্যে নড়িয়ার সুরেশ্বর এলাকায় ১ কিলোমিটার লম্বা বাঁধ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বাঁধটির ৫০ মিটার নদীতে বিলীন হয়।

বর্তমানে পদ্মা নদীর ৭০ মিটারের মধ্যে রয়েছে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৪০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে নড়িয়া উপজেলা শহর। গত বছরের ভাঙনের হিসাব অনুযায়ী, এখনই ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আগামী মৌসুমের মধ্যেই শহরটি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই এলাকায় বাঁধ নির্মাণের দাবিতে জাজিরা ও নড়িয়াবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। ঢাকার রাজপথসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত হচ্ছে মানববন্ধন ও গণ-অনশন কর্মসূচি।

জাজিরার কুণ্ডেরচর ইউপির চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন মাদবর বলেন, ‘গত ১০ বছরে তিন দফা ভাঙনের শিকার হয়েছি। এখন আমার ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ইউনিয়নের ৯০ ভাগ পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।’

সিইজিআইএসের রিভার ডেলটা অ্যান্ড কোস্টাল মরফোলজি বিভাগের প্রধান সুদীপ্ত কুমার হোড় প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীয়তপুরের ওই এলাকায় আমরা গত মে পর্যন্ত গবেষণা করেছি। স্যাটেলাইটের ছবির মাধ্যমে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নদীর গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা যেমনটা পূর্বাভাস দিয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাঙন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার বৃষ্টির মাত্রা আর পদ্মায় স্রোত ছিল বেশি। এখনো স্রোত রয়েছে। ফলে সেখানে সারা বছর ভাঙনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।’

ফরিদপুরে অবস্থিত নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে ভাঙন প্রকট থাকার কথা নয়। পদ্মার শাখানদী ভরাট হয়ে যাওয়া এবং নদীতে চর পড়ে যাওয়ার কারণে স্রোত একটি স্থানে এসে আঘাত হানছে। চর ও ভরাটের কারণে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করবে। ওই স্থানে পদ্মা ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।