মায়ের মুখে প্রায়ই শুনতাম, কাক কেন ভালো করে হাঁটতে পারে না। যদিও এই বিষয়টা একটা নিছক গল্প। সত্যতা সম্পর্কে মায়ের কাছে তথ্য উপাত্ত ছিল না তবে এই গল্পেরও শিক্ষণীয় পাঠটিকা রয়েছে। গল্পটা ছিল, প্রাচীনকালে কোনো এক রাজা পাখিদের হাঁটার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সব পাখিই অংশ নেবে বলে প্রস্তুতি নেয়। কাকও এই প্রতিযোগিতার একজন প্রতিযোগী, কাক নিজেকে শ্রেষ্ঠ করার জন্য অন্য পাখিদের হাঁটা অনুকরণ করা শুরু করে। কাক প্রথমে ঘুঘুর কাছে যায়, ঘুঘু কিভাবে হাঁটে তা শেখার চেষ্টা করে। ঘুঘুর হাঁটা শেখার পর ঘুঘুর হাঁটা টাও কাকের মনোপুত হয় না। তাই কাক অন্য পাখিদের কাছে যায়। এ রকম করে কাক একে একে অনেক পাখির হাঁটা অনুকরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো হাঁটাই তার ভালো লাগে না। অবশেষে কাক নিজের স্টাইলের হাঁটায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই বেশ কিছু পাখির হাঁটা অনুকরণ করায় কাক নিজের হাঁটার পদ্ধতিটাও ভুলে যায়। তাই কাক এখন লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, অন্য পাখিদের মতো হাঁটতে পারে না। এই বিষয়টি এখানে অবতারণা করার উদ্দেশ্য হলো, আধুনিকতার নামে বাংলাদেশের বহু মানুষ অতীত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছে, কোথাও কোথাও তা ধ্বংস করে ফেলছে। আসলে সংস্কৃতিটা কি তা জানার প্রয়োজন আছে। সাধারণত সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি, কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তির প্রকাশ তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বকীয়তা বজায় রাখা এবং টিকে থাকার কৌশল। পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই হলো সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের সংস্কৃতি প্রথা বা ব্যবহারিকতা ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। মানুষ এই বৈশিষ্ট্যগুলো তার পুর্ব পুরুষের কাছ থেকে পেয়ে থাকে আবার অনেক সময় যুগের প্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়। তাই সংস্কৃতি যেমন আরোপিত অর্থাত্ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তেমন অর্জিত। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির যৌগিক সন্বয় হলো সংস্কৃতি।
বংশ পরম্পরায় সংস্কৃতির ধারাকে লালন করাটা মানুষের ঐতিহ্য। অনেকেই ঐতিহ্যকে লালন করাটা রক্ষণশীলতা মনে করেন। বস্তুত রক্ষণশীলতা সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ। তবে কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতি সেই অঞ্চলের ভাষাভাষী মানুষ এবং তাদের জীবন প্রণালির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে তাকে ধর্মীয় ফ্রেমে ফেলে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বিপ্লবী হওয়ার জন্য এক সময় রুশ সংস্কৃতি লালন করে, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরস্ফুিটন ঘটাতে তারা চেয়েছিল যার জন্য এদেশের বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ক্ষয়িঞ্চু অবস্থা আজ। ঐতিহ্য আকড়ে থাকাটা রক্ষশীলতার পরিচয় বহন করে আবার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা অনেকটা শিকড়বিহীন গাছের পরিণত হওয়া। যেমন বর্তমানে ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে বহিঃবিশ্বের সয়েমড় বাঙালির সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিনিময় ঘটছে। তা কিন্তু নিজস্ব বলয়ের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুতি হওয়ার জন্য নয় বরং সকলের সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো।
রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার বরেন্দ্র অঞ্চলের পাঠ অনুশীলনের সুতিকাগার। বরেন্দ্র তথা উত্তর বঙ্গের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগে জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠানটি। তাই এই প্রতিষ্ঠানটি এই অঞ্চলের শিক্ষা সংস্কৃতির ধারক বাহক। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য। এই গ্রন্থাগারটি ঘিরেই করে বিস্তৃতি ঘটে এই অঞ্চলের শিক্ষার আধুনিকতার ছোয়া। এই গ্রন্থাগারটি বহু প্রাচীন। আবদুর রশিদ খান রচিত একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় , ‘১৮৮৪ সালে এই পাঠাগারটির গোড়াপত্তন বহু আগে ঘটেছিল, নাটোরের রাজ পরিবারের ছোট তরফের রাজা আনন্দ রায় ১৮৬৬ সালে এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৪ সালে জমি এবং ভবন প্রাপ্তির পর এই প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ী রূপ পায়। ১৮৮৪ সালের নান্দনিক নকশায় তৈরি ভবনটি ওই সময়কার স্থাপত্য কলার নিদর্শন বহন করে আসছে। স্থাপত্যকলার নিজস্ব একটি ধারা আছে। স্থাপত্য কলার সংস্কৃতিটি তার ঐতিহ্য গত বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের আধুনিক স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনের বহু তল ভবনের নকশা এবং রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটির নকশার মাঝে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের ভবনটি উত্তরাঞ্চলের পাঠ অনুশীলনের ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন তবে এই ভবনটিও স্থাপত্য বিভাগের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের একটি পাঠ উপকরণ হিসেবে গণ্য করা যায়, কারণ এর মূল নকশা নির্মাণশৈলী বর্তমান স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভবনের নকশা তৈরির বিবর্তনের ধারাটির একটি ধারণা দেবে।
আবদুর রশিদ খানের গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদা নাথ রায় রাজশাহীর মিয়াপাড়াস্থ সাধারণ গ্রন্থাগারটির জমিদান করেছিলেন। বর্তমানে রাজশাহী গ্রন্থাগারটির চৌহদ্দির মোট জমির পরিমাণ .৪৪ একর।’ প্রায় অর্ধ একর জমির উপর ১৮৮৪ সালের ভবনটি অবস্থিত। মূল ভবনটি মোট আয়তনের যত সামান্য অংশ দখল করে আছে। ভবনটির বয়স প্রায় ১৩৩ বছর। আর এই ভবনটি ঘিরে আছে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের স্মৃতি জড়িত। যারা এই গ্রন্থাগারটি পরির্দশনে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ১৯২৫ সালের ১ জুলাই মহাত্না গান্ধী গ্রন্থাগারটি পরির্দশনে আসেন। তাছাড়া নেতাজী সুভাষ, সরোজিনী নাইডু, বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বাবু উপেন্দ্র নাথ রায়, সুরেন্দ্র নাথ মল্লিক, শরদিন্দু মুখার্জি, ড. মুহাম্মাদ শহিদুল্লাগসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি। এ রকম মহান মনীষীদের স্পর্শ রয়েছে আজকের এই প্রাচীন নির্দশন হিসেবে খ্যাত এই রাজশাহীর সাধারণ গ্রন্থাগার ভবনটিতে। গান্ধীজী নোয়াখালীতে গিয়েছিলেন তাই নোয়াখালীর জয়াগে গান্ধীজীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গান্ধী আশ্রম গড়ে উঠেছে। উপমহাদেশের স্বাধীনতা এবং মানব মুক্তির অনন্য ভূমিকার অধিকারীগণ এই ভবনটিতে অবস্থিত গ্রন্থাগার পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের স্মৃতিকে সম্মোজ্জ্বল করে রাখার জন্য এই ভবনটি ধরে রাখা দরকার। বর্তমানে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি এক প্রত্নতত্ত্ব নির্দশন হিসেবে রূপ নিয়েছে। কারণ প্রত্নতত্ত্বের বিশেষত্ব হলো, প্রত্নতত্ব একটি বস্তুগত নির্দশন অর্থাত্ প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে কাজ করে এবং প্রত্নতত্ত্ব মানুষের জীবন ধারার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে সেই সঙ্গে মানুষের জীবন ধারার সম্পর্ক নির্ণয় করে। রাজশাহী গ্রন্থাগার ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব এর একটি নির্দশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় উপরোক্ত সঙ্গার আলোকে। তাছাড়া প্রত্নতত্ত্বের মূল বিষয় হলো, ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জৈব অবশেষ বা জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক দৃশ্যাবলী ইত্যাদি। প্রত্নতত্ত্বের কাজ হলো এইসব বিষয়বলি বিশ্লেষণ করে মানুষ প্রাচীনকালের মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির তত্কালীন চিত্র বুঝতে পারে। এই বুঝা যাওয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতি এবং পরিবেশের পরিবর্তনের ধারার ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভবিষ্যত্ মানুষের জন্য জীবন চলার রূপরেখা নির্মাণ করতে পারে।
এসব দিক বিচেনায় নিলে, বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব হিসেবে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারকে বিবেচনা করা যায়।
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব আইনে বলা আছে, ২নং ধারায় খ অনুচ্ছেদ বর্ণিত রয়েছে যে, ১. স্থাবর প্রত্নসম্পদের সময় সীমা ১০০ বছরের পুর্ববর্তী যে কোনো সময় বা তত্কালের সঙ্গে সম্পর্কিত।
২. অস্থাবর প্রত্নসম্পদের বিশেষত শিল্পকলা সম্পর্কিত প্রত্নসম্পদের সময়সীমার ক্ষেত্রে ৭৫ বছর বা পূর্ববর্তী সময়ের যে কোনো সময় বা তত্কালের সহিত সম্পর্কিত। ৩. উপরোক্ত সময় সীমার আওতাভুক্ত না হলেও বিশেষ স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ) সাংস্কৃতিক স্থাপনাসমূহ প্রাচীন বলিয়া বিবেচিত হইবে।
এই আইনের গ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রত্নসম্পদ’ অর্থ মানুষ দ্বারা সম্পাদিক/সৃজিত/প্রভাবিত স্থাবর ও অস্থাবর শিল্পকর্ম, স্থাপত্য, কারুকর্ম, সামাজিক প্রথা, সাহিত্য নৈতিকতা, রাজনীতি, ধর্ম, যুদ্ধবিগ্রহ বিজ্ঞান বিষয়ক সভ্যতা, পরিবেশগত বা সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বহনকারী যে কোনো প্রাচীন নির্দশন।
ঐতিহাসিক, জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সামরিক বা বিজ্ঞান সমৃদ্ধ যে কোনো নির্দশন বা স্থান। এই আইনের উদ্যেশ পুরণকল্পে সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রত্নতত্ব সম্পদ ঘোষিত এরূপ যে কোনো প্রাচীন নিদর্শন বা ইহার শ্রেণি। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। একে একটি স্থাপনা হিসাবে বিবেচনায় নিলেও স্থাপনাটির বয়স হয়েছে একশ তেত্রিশ বছর। নিয়মানুসারে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের ভবনটিও প্রত্নসম্পদ। সম্প্রতি সাধারণ গ্রন্থাগারটি আধুনিকায়ন করারকল্পে মূল ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থাগারটির মূল ভবনটি ভেঙ্গে ফেললে একটি প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করার হবে। বাংলাদেশের বহু প্রত্নসম্পদ আধুনিক করার নামে ধ্বংস করা হয়েছে। তাছাড়া ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এ ভবনটি ইতিহাসের একটি অংশ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে আধুনিকায়ন হচ্ছে, পরির্বতন বা বিবর্তনও ঘটছে, তারপরও ঐতিহাসিক কৃষ্টি সংস্কৃতি লালন করেই মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই রাজশাহীর সাধারণ গ্রন্থাগারটি বরেন্দ্র অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলার একটি প্রাচীন সংস্কৃতির নিদর্শন একে অক্ষুণ্ন রাখা উচিত। আগামী প্রজন্মের কাছে সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারার অনুশীলনের একটি পাঠ হিসাবে এই ভনটি একদিন অন্তর্ভুক্ত হবে। সাধারণ গ্রন্থাগারের মোট জমির পরিমাণ অর্ধ একর। মূল ভবনটি অক্ষত রেখে বাকি জায়গায় গ্রন্থাগার সম্প্রসারণের কাজটি করলে মূল ভবনটিই পাঠ উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হবে পাঠকদের কাছে। তাই মূল ভবনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ করা দরকার।
মূল ভবনটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অক্ষত রেখে সাধারণ গ্রন্থাগারের সম্প্রসারণ করার উচিত বলে মনে করে রাজশাহীর মানুষ। কারণ সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুতি ঘটলে সেই কাকের হাঁটার মতো আমাদের সংস্কৃতির পরিণতি হবে সেই বিষয়টিও সকলেরই ভাবা দরকার।
লেখক : কলামিস্ট