বাংলাদেশের শিশু উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা

131

(উদিওন ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি সামাজিক প্রয়াস)

এ্যান্থনী পিউস গোমেজ, ভার্জিনিয়া

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং সাফল্যের সাথে লক্ষ্য অর্জন করে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। উন্নয়নের জোয়ার বইছে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের দেশের উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রায় পৌছাতে হলে এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন এবং পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুদের দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার সফল প্রয়াস।  ছোট্ট ভৌগলিক সীমনায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৬ কোটিরও বেশি শিশু। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হলেও বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মান এখনো অনেক পেছনে। বাংলাদেশের দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নানা সামাজিক রীতি-নীতি, লিঙ্গ বৈষম্য, আইন ও উন্নয়ন পরিকল্পনার কার্যকারিতার ঘাটতি এবং অত্যাবশ্যকীয় সেবা পৌঁছানোর প্রতিবন্ধকতা-  এসব কিছু মিলেই শিশুর গঠন, বেড়ে উঠা, তাদের অধিকার আদায়, উন্নয়ন এবং সমাজে তাদের অংশগ্রহণ  এসব গুরুত্বপূর্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রয়াস বা উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্বেও অগ্রগতি আশানুরুপ হয়ে উঠেনি নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলগুলোর  পথ ধরে প্রয়াস অব্যাহত ছিল বিগত প্রায় দুই দশক ধরে, অগ্রগতি বা অর্জন হয়েছে বেশ কিছুটা, কিন্তু তারপরও পুরোপুরি লক্ষ্য অর্জন হয়নি। এর সূত্র ধরে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমাদের এখনো অনেক কাজ বাকী, এখনো কাজ করার প্রচুর জায়গা রয়েছে এই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করে আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত নারী এবং শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার।

দেশে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে অনেক প্রকল্প এগিয়ে চলেছে, অনেক সাহায্য সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত নারী এবং শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগিয়ে যাবার জন্য যে প্রয়াস এবং পথচলা অব্যাহত রয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে, তা প্রসংশযোগ্য কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারেন এতে সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু সম্ভব, সবাই যদি তা করার জন্য সহৃদয় হয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের নারী ও শিশুদের প্রাথমিক উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে বিরাট অবদান রাখতে পারবে্ন। এছাড়া প্রবাসী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেমন আমাদের ভাষা,সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করে যাচ্ছেন, আয়োজন হচ্ছে অসংখ্য অনুষ্ঠানের… ঠিক তেমনি সাংস্ক্তিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে এবং আমাদের সাংগঠনিক প্রয়াসের মাধ্যমে সবার মাঝে এই সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে স্বদেশ সেবায় সবাইকে অনুপ্রাণিত বা উদবুদ্ধ করার জন্য। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে অনেক মহৎ কাজ সম্ভব এবং আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুদের সেবায় এগিয়ে এসে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আমরা সত্যিই পাড়ি প্রবাসে থেকেও দেশের সেবা করতে এবং এটা আমাদের প্রবাসী সমাজের একটি নৈতিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা এবং স্বদেশের প্রতি গভীর ভালবাসার টানেই ওয়াশিংটনের সামাজিক সংগঠন “উদিওন ফাউন্ডেশন” এগিয়ে এসেছে একটি ভিন্নধর্মী প্রয়াস বা প্রকল্প হাতে নিয়ে-    শিশুদের প্রামমিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক গঠনের লক্ষ্যে একটি বাস্তবমুখী “প্রশিক্ষণ কর্মশালা” প্রকল্প নিয়ে। মেরীল্যান্ডস্থ “মন্টগোমারী কমিউনিটি কলেজ”-এর সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মত ‘উদিওন ফাউন্ডেশন’  এধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা হাতে নিয়েছে, মূল উদ্দেশ্য- স্থানীয় সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার কর্মকর্তাসহ স্থানীয় এবং বিদেশী এনজিও বা সাহায্য সংস্থার কর্মীদের নিয়ে একটি উপযোগী কর্মশালার আয়োজন করা, যাতে অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকে নিজেদের দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলে স্থানীয়  অন্যান্যদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে এবং এমনি করে  ধারা অব্যাহত রেখে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তোলা যায় বৃহৎ  কর্মী বাহিনী, যারা মূলতঃ ভূমিকা রেখে যাবে আমাদের প্রতিটি অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক উন্নয়নে, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানসিক গঠন, সামাজি ন্যজ্যতা, লিঙ্গ বৈষম্য দূরিকরণ, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসকরণ, দ্রারিদ্রতা মোচন, জীবনমান উন্নয়নের জন্য পরিবেশ উন্নয়ন, নারী ও শিশুদের প্রতি সামাজিক তথাকথিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন  ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে অনেকগুলো এনজিও এক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিরাট ভূমিকা রেখে যাচ্ছে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি, যেমন –   ইউনিসেফ, সেইভ দ্যা চিল্ড্রেন, কারিতাস বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ডভিশন ইত্যাদি।

ইউনিসেফ এবং সেইভ দ্যা চিলড্রেন পরিচালিত গবেষণা ও তথ্য অনুসন্ধান অনুযায়ী প্রতি বছর ৭.৬ মিলিয়ন শিশু  মৃত্যুবরণ করছে ৫ বছর বয়সের আগেই।  ২০০ মিলিয়ন শিশুর বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হলেও পূর্ন মানবিক বিকাশের সুযোগ তাদের হয়ে উঠে না। তবুও বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে অনেক দ্রুততার সাথে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে,  যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।  তৃণমূল পর্যায়ে গর্ভধারণকাল  থেকে শুরু করে শিশু ও মায়েদের পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ইউনিসেফ। শুধু তাই নয়, মৌলিক পরিচ্ছন্নতার জন্য সবাইকে সচেতন এবং অনুপ্রাণিত করার জন্যও ইউনিসেফ কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয়ের অধিনে শিশু সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে দুইটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, প্রকল্প দু’টি হচ্ছে-  চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প এবং সার্ভিসেস ফর দ্যা চিলড্রেন এট রিস্ক।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সমাজকর্মীরা তাদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবিষয়ে অবগত ও দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলে এক বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন- অভিভাবক, শিশু সেবাদানকারী, সমাজকর্মী এবং সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষ যারা এক্ষেত্রের সাথে সম্পৃক্ত, তারা আয়োজিত এধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন এবং  এমনি অসংখ্য ছোট ছোট প্রয়াস অব্যাহত থাকলে তা একসময় বৃহত্তর বলয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হবে এতে সন্দেহ নেই। উদিওন ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার বিস্তারিত তথ্য সন্নিবেশিত করা হল সবার অবগতি ও সুবিধার জন্য। এটা প্রথম আয়োজন হলেও, আগামীতেও এই প্রয়াস অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে উদিওন ফাউন্ডেশন। আসুন আমরা ক্ষুদ্র পরিসর থেকেই আমাদের প্রয়াস এবং চেষ্টা অব্যাহত রেখে আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুদের কল্যানে ব্রতী হই, আমাদের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হোক দেশের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ, দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসা!  উদিওন ফাউন্ডেশন এই মহতী প্রয়াসকে অভিনন্দন এবং এর সাফল্যের জন্য অনেক শুভকামনা। প্রবাসের বিভিন্ন অঙ্গনের  ব্যক্তিবর্গ এমনি মানব কল্যানমূলক কাজে সহভাগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসার ছোঁয়ায়, এটাই একমাত্র প্রত্যাশা।