মার্কিন ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কনভেনশন শুরু হয়েছে গতকাল সোমবার। কনভেনশনের প্রথম রাতের সমাপনী বক্তব্য রাখেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। মিশেল তাঁর বক্তব্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এমনভাবে আক্রমণ করেছেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মুখে মুখে থাকবে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কনভেনশন প্রথমবারের মতো ভার্চ্যুয়াল পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল থেকে শুরু হওয়া এই কনভেনশন আমেরিকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। প্রথম রাতের কার্যক্রম কিছুটা ধীর গতিতে শুরু হয়। শুরুতেই পুরো আমেরিকায় মহামারির কবলে পড়া মানুষের কথা স্মরণের পাশাপাশি এই সময়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি ও রাজনীতির সমালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জো বাইডেনকে কেন বাছাই করা হলো, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। এ পর্যায়ে বাইডেনের নেতৃত্বে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ও ন্যায্যতার প্রশ্ন সামনে রেখে একটি সংক্ষিপ্ত প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
অনেকে তাঁদের বক্তব্যে মহামারি মোকাবিলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা তুলে ধরার পাশাপাশি ডাকযোগে ভোটদানের পথ রুদ্ধ করতে ডাক বিভাগের বাজেট কর্তনের তীব্র সমালোচনা করেন। স্মরণ করা হয় সেই সব মানুষকে যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একে একে বক্তব্য রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ডেমোক্র্যাট নেতারা। তাঁদের সবার বক্তব্যে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল জো বাইডেন ও কামালা হ্যারিসের পেছনে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক।
‘আমরা না পারলে পরিস্থিতি আরও বাজে হবে’
কনভেনশনের প্রথম রাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি রাখেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। প্রায় ১৯ মিনিট দীর্ঘ এ বক্তব্যে মিশেল বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনকে রীতিমতো ধুয়ে দেন। মিশেল বলেন, ‘যতটা সম্ভব সৎ ও পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করছি, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের দেশের জন্য ভুল প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাজ করার জন্য, নিজেকে প্রমাণ করার যথেষ্ট সময় পেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাম্প এমন কোনো ব্যক্তি নন, যাঁকে আমাদের প্রয়োজন। তিনি তাঁর সময়কে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
মিশেল ওবামা বলেন, ‘আমাদের বর্ণ, বয়স, ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন আমি জানি, যদি যাবতীয় শঙ্কাকে অতিক্রম করে মন খুলে আমরা আমাদের ভেতরের কথা শুনি, তবে জানব যে, আমাদের দেশে যা কিছু হচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, মহামারিতে আমেরিকার ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই বর্ণবাদ উসকে দিয়ে আমেরিকার শহরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। মিশেল ওবামা বলেন, ‘মিথ্যা ও অবিশ্বাসের শিকল ভাঙার মধ্য দিয়েই একমাত্র আমরা মুক্তি পেতে পারি।’
ট্রাম্পকে বিশ্বাস করাই তাঁর কাল হয়েছিল
নানা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ভার্চ্যুয়াল কনভেনশন সফলভাবে শুরু করতে পেরেছে ডেমোক্র্যাটরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্ধারিত সময়ে কনভেনশনে কত জন যোগ দেবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু শুরু হওয়ার পর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। কনভেনশনের শুরু থেকেই জো বাইডেন আলোচনায় ছিলেন। মনে হচ্ছিল, এটি তাঁর প্রাথমিক বাছাই পর্বের কোনো সম্মেলন। সম্মেলনের শুরুতে কয়েকজন ভোটার তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন ক্রিস্টিন উরকুইজা।
ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে দেওয়া বক্তব্যে কিছুদিন আগে বাবাকে হারানো ক্রিস্টিন বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন ৬৫ বছরের একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে তাঁর একমাত্র উপসর্গ ছিল, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেছিলেন। আর এ জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। আমার বাবা ট্রাম্প ও তাঁর মাউথপিসটিকে বিশ্বাস করেছিলেন, যখন বলা হচ্ছিল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং খুব শিগগিরই নির্মূল হবে।’
সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার স্কাইলার নামের পাঁচ বছর বয়সী শিশুর কথা স্মরণ করেন, যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো তাঁর বক্তব্যে একইভাবে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের জাতি সংকটের মধ্যে রয়েছে, যার অনেক কিছুই কোভিডের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্য হয়েছে।’
জর্জ ফ্লয়েডও হাজির ছিলেন
পুলিশের নির্যাতনে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড এই কয়েক দিন আগেই পুরো আমেরিকা তোলপাড় করেছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির ভার্চ্যুয়াল কনভেনশনে এই ফ্লয়েডই হাজির ছিলেন। না, সশরীরে নয়। জর্জ ফ্লয়েডের পরিবারের সদস্যরা যুক্ত হয়েছিলেন কনভেনশনে। ঠিক যেমনটা যুক্ত হন ছয় বছর আগে নিউইয়র্কে পুলিশের নির্যাতনে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এরিক গার্নারের মা। তাঁদের পক্ষ থেকে বর্ণবাদবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপনের পাশাপাশি ন্যায্য বিচারের দাবি জানানো হয়।
এরিক গার্নারের মা গোয়েন কার বলেন, ‘আমার ছেলে যখন মারা গেল, তখন সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠল। তারপর সব আবার শান্ত। আমরা এভাবে সব ভুলে যেতে দিতে পারি না। রাজনীতিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে আমাদের। না হলে এই বিক্ষোভের কোনো অর্থই থাকে না।’
বাইডেনের পাশে স্যান্ডার্স
দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পেতে লড়েছিলেন ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। কিন্তু এবারও তিনি পারেননি। আগেই সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে তাঁর সমর্থকেরা এখনো আছে, যেমন আছেন তিনি। ফলে দলীয় ঐক্যের জন্য স্যান্ডার্সের বক্তব্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। কনভেনশনের প্রথম রাতে স্যান্ডার্সের দিকে সবার বিশেষ মনোযোগ ছিল। অনুমিতভাবেই স্যান্ডার্স তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে বাইডেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবার এবং আপনাদের অনেকেই ভালোভাবে জানেন যে, কর্তৃত্ববাদ কীভাবে গণতন্ত্র, ন্যায় ও মানবতার ক্ষতি করে। যত দিন আছি, আমাদের জাতিকে সেই ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য আমি প্রগতিশীলদের সঙ্গে, মধ্যপন্থীদের সঙ্গে এবং এমনকি রক্ষণশীলদের সঙ্গেও কাজ করতে রাজি, যার জন্য আমাদের বীরেরা লড়াই করেছেন।’
স্যান্ডার্স তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমাদের বলা যেসব ধারণাকে র্যাডিক্যাল বলা হতো, আজ সেগুলো মূলধারার বিষয়। কিন্তু এটা মনে রাখা জরুরি, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পুনর্নির্বাচিত হন, তবে আমাদের এত দিনের সব অর্জনের জলাঞ্জলি হবে।’
বাইডেনকে রিপাবলিকান নেতার সমর্থন
নির্বাচনী দৌড়ের শুরু থেকেই বাইডেন বলে আসছিলেন, মধ্যপন্থী রিপাবলিকানরাও তাঁকে সমর্থন জানাবেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন ট্রাম্পকে পরাজিত করার যোগ্যতা তাঁরই শুধু আছে। কনভেনশনের শুরুর দিনে অন্তত তেমন প্রমাণ মিলল। ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে বাইডেনকে সমর্থন জানিয়ে ধারণকৃত বক্তব্য রাখেন ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থিতার জন্য লড়াই করা জন কাসিচ। ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘আমি সারা জীবন রিপাবলিকান। কিন্তু দলের চেয়ে দেশের প্রতি আমার আনুগত্য বেশি। দল এ তালিকায় দ্বিতীয়। রিপাবলিকান ঐতিহ্য নিয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প দলের মূলনীতিকেই অশ্রদ্ধা করছেন।’
শুধু জন কাসিচ নন, রিপাবলিকান হয়েও বাইডেনকে সমর্থন জানিয়েছেন ২০১০ সালে রিপাবলিকান দলের হয়ে গভর্নর নির্বাচনে অংশ নেওয়া মেগ হুইটম্যান, নিউইয়র্কের সাবেক কংগ্রেসওম্যান সুসান মোলিনারি ও নিউজার্সির সাবেক গভর্নর টড হুইটম্যান।