Azadul Haq, Houston, Texas
হিরো আলমের মনোনয়ন পত্র কেনার পর থেকেই তাঁকে নিয়ে যে সস্তা বিনোদন আর কদর্য কৌতুক করা হচ্ছে সেটা আমাদের সামাজিক চরিত্রের কোন দিকটা তুলে ধরছে তা একটু ভাবার ব্যাপার। হিরো আলম যদি তার এলাকা থেকে এমপি হয়ে জিতে আসতে পারে তবে অন্য কারো মাথাব্যাথা কেন? সংবিধানের কোন ধারায় বলা আছে, সাংসদদের দাঁত সুন্দর হতে হবে, লম্বা, ফর্সা নাদুসনুদুস হতে হবে? যেখানে অনেক নেতার ভাষণ দিতে গিয়ে পায়জামা খুলে যায়, লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হয়, মিছিলে গিয়ে গায়ে হাত লাগলেই হাসপাতালে গিয়ে নাকে অক্সিজেন দিতে হয় সেখানে হিরো আলম কি দোষ করল?
আসলে এই হিরো আলম আর এটিএন এর মাহফুজরা যা করছে তা করার মতন বুকের পাটা আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করি, ফেসবুকে ট্রল করি, কিন্তু ঠিকই বুঝি যে নাহ, আসলেই এরা অত্যন্ত সাহসী। আমাদের অনেকেই জীবনটাকে বেঁধে রেখেছি আমরা নিজেরই বানানো শিকলে, পাছে লোকে কিছু বলে!! আপনার ভীষণ গান গাইতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কখনো গান না, পাছে লোকে কিছু বলে। আপনি একটা মেয়ে কিন্তু আপনার ফুটবল খেলতে খুবই ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনদিন মাঠে গিয়ে বলে একটা লাথি মারার সাহস হয় নি। পাছে লোকে কিছু বলে। আপনার ইচ্ছে করে মসজিদে গিয়ে একদিন আজান দিতে। কিন্তু ভয়ে কাউকে কোনদিন বলেননি। পাছে লোকে কিছু বলে। এমন অসংখ্য শখ আমরা পুশে রাখি নিজের ভেতর, সংকোচে করি না, বলিও না, পাছে লোকে কিছু বলে।
কিন্তু এই হিরো আলম আর মাহফুজেরা থোড়াই কেয়ার করে এই পাছে লোকে কিছু বলার। তাঁরা তাদের যা মন চাইছে তাই করছে এবং দেখিয়ে দিচ্ছে সবাইকে কিভাবে করতে হয়। তাঁরা কি কোন অসৎ পথে এই কাজ করছে, কারো ক্ষতি করছে? তবে আমাদের এতো মাথাব্যাথা কেন?
আমাদের মাথাব্যাথার কারণ অন্য জায়গায়। আমাদের ছোটবেলা থেকে কিছু ভুল সংজ্ঞা শেখানো হয়েছে। ফর্সা মানে সুন্দর, লম্বা মানে রূপবান, ধনী মানে ভালো এই রকম অজস্র ভুল সংজ্ঞায় আমাদের মাথা গিজগিজ করে। রূপালী পর্দায় দেখানো হয়েছে এক স্বপ্নের জগত যেখানে শুধু সুন্দর মানুষেরাই নায়ক নায়িকা হয়। অথচ আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত নায়ক, কত নায়িকা তাদের আমরা দেখতে পাই না।
যে মা সারাদিন নিজের দিকে না তাকিয়ে তার সন্তানদের জন্য সময় দেয় তার থেকে বড় নায়িকা আর আছে কোথায়? যে বাবা টিফিন বক্সে করে দুটো রুটি নিয়ে অফিসে যায় অল্প টাকা বাঁচিয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে তার চেয়ে বড় নায়ক আর পাবেন কোথায়? যে ঘর্মাক্ত রিকশাচালক রোজা রেখে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যায় ইফতার করতে যায় তার পরিবারের সাথে, সেও তো নায়ক। যে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নিজের সামান্য বেতনের টাকা থেকেও ছাত্রদের সাহায্য করে স্কুলে আসতে, সেও তো নায়ক। এই ধরণের নায়ক, নায়িকাদের আমরা তুলে ধরি না আমাদের সন্তানদের সামনে। তো তাঁরা কি করে শিখবে?
আমি ছোট বেলায় খুব বেটে ছিলাম তাই স্কুলে এসেম্বলীর সময় আমাকেই দাঁড়াতে হত লাইনে সবার সামনে। আমার বন্ধুরা হাসত আর আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। সেটা ছিল আমার ব্যর্থতা। তারপর দেখলাম এটা কোন ব্যাপারই না। শুধুই মনের ব্যাপার। ধীরে ধীরে নিজের অপারগতা, অক্ষমতা, অপূর্নতা গ্রহণ করতে শিখে নিয়েছি। আমার এখনো এমন অনেক অক্ষমতা আছে। এখনও ইংরেজী ভুল উচ্চারণ করি, বলি একটা আর মানুষ বোঝে আরেকটা! কিন্তু আমি আমার মত করেই বলে যাই। খেলতে পারি না, দৌড়াতে পারি না, কিন্তু ফুটবলের মাঠে ঠিকই যাই। লোকে হয়ত হাসতে পারে দেখে যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের সাথে এই লোকটা কি করছে। কিন্তু আমি তো আমার স্বাস্থ্যের সুফল ঠিকই পাচ্ছি, আনন্দ পাচ্ছি। ক্ষতি কি?
একবার আমাদের ধনী এক প্রতিবেশীর বাড়ীর বিয়ের দাওয়াত পেলাম। সেটা হবে এক হোটেলে আর তাও আবার রাতের বেলায়। আমাদের কোন গাড়ী ছিল না। আমরা সব জায়গায় রিক্সায় না হয় হেঁটে যেতাম। হোটেলে তো রিক্সা যাবে না, আচ্ছা সেটা না হয় একটা বেবী স্কুটারে করে যাওয়া যাবে। কিন্তু পড়বটা কি? স্যুট তো বহু দূরের কথা, আমার কোন জ্যাকেটও নেই। আম্মার হাতে বোনা সোয়েটার, জাম্পার আর চাদর এই ছিল তখন আমার সম্বল। কিন্তু এ পরে তো এই বড়লোকের বিয়েতে যাওয়া যাবে না। আবার না গেলেও নয়। পরে গুলশানে গিয়ে সেই নিক্সন মার্কেট বা লান্ডি বাজারে গিয়ে একটা পুরনো জ্যাকেট কিনলাম ৭০ টাকায়। সেটা ধুয়ে ইস্তিরি করে সেই বিয়েতে গেলাম ডাটের মাথায়। শুধু কি তাই? কয়েকজন আবার প্রশংসাও করল সেই জ্যাকেটের! নিজের অক্ষমতা থাকতে পারে কিন্তু সেটাকে অক্ষমতা হিসেবে না ধরে নিয়ে গ্রহণ করে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে বেঁচে থাকা।
আমাদের সবার মাঝেই একটু আধটু ছেড়া ফাড়া, ফুটো ফাটা আছে। হিরো আলম তার এই সব ফুটো ফাটা জয় করে নিজেকে বড় করে তুলেছে। সেজন্য সে অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। আলিবাবার জ্যাক মা কি নিজের চেহারার জন্য মন খারাপ করে বাসায় বসে ছিল? নাকি পাপুয়া নিউ গিনির রিপ্রেজেন্টিটিভ কেয়ার করেছিল কাউকে ইউএনের মিটিং-এ এই ড্রেস পড়ার সময়? এটিএন এর মাহফুজ ভাই গান না গাইতে পারেন অনেকের ধারণা মাফিক। কিন্তু উনি কি সেজন্য বসে আছেন? তিনি তার নিজের মত করে আনন্দে আছেন! অন্য মানুষের দোষ, ত্রুটি না খোঁজ করে নিজের দিকে তাকানোই শ্রেয়।
আর সে সব মিডিয়া জাতীয় নির্বাচনের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়কে সস্তা বিনোদন দিয়ে কলুষিত করতে চাচ্ছেন, তাঁরা নিন্দনীয়। তাদের উচিত এমন সব তথ্য তুলে ধরা যাতে করে দেশের মানুষ জানতে পারে, বুঝতে পারে ভোট দেয়া কতখানি জরুরী, কিভাবে ভোট দেয়া যাবে, তার অধিকার কত টুকু, একজন প্রার্থী সম্পর্কে কি কি জানা উচিত ইত্যাদি। বিনোদনকে বিনোদনের জগতে রাখাই শ্রেয়।
তবে যত যাই বলেন, যতবার এই আলমের নাম নিচ্ছেন ততবারই তার নামের আগে আপনাকে বলতে হচ্ছে “হিরো”। কারণ আসলে সেই একজন হিরোই।
– এই পোস্ট বা আমার যে কোন পোস্ট শেয়ার করার জন্য আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।