সৌন্দর্যচর্চার ইতিহাস দীর্ঘ। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সৌন্দর্যপিপাসু। এ শুধু বহিরাঙ্গের চাকচিক্য নয়, অন্তরঙ্গের প্রকাশও। প্রতিটি ভাষার কাব্যে নানা উপমায় উজ্জ্বল হয়েছে অঙ্গসৌষ্ঠবের অপরূপ বর্ণনা। মনের গভীরে যে ভাবনার উদয়, যে উপমার উদগীরণ, তা শুধু দৈহিক নয়; মনোদৈহিক। দর্শনধারী এ চর্চায় ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব। আর যাঁরা নান্দনিক ভাবনায় মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেন, তাঁরা রূপকারিগর।
এমনই এক রূপকারিগর আফরোজা পারভীন। দেশে দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বা সৌন্দর্য শিল্পের সঙ্গে জড়িত। রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালনের কর্ণধার তিনি। তবে এ শুধু আক্ষরিক পরিচয়। প্রান্তিক নারীকে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে উপার্জনক্ষম করে তোলায় তাঁর অবদান অনেক। নারীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তোলাই আফরোজার মূল ভাবনা।
কিন্তু কে জানত, একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের আকস্মিক হানায় বদলে যাবে সব চিত্রপট। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে নাকাল জনজীবন। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। জীবন বাঁচাতে যেখানে সামাজিক-শারীরিক দূরত্বই মুখ্য, সেখানে সৌন্দর্যভাবনায় ভাটা পড়বে, এ স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁদের রুটিরুজি এ শিল্পের ওপর নির্ভর, লকডাউনের এই সময়ে তাঁরা কেমন আছেন? যেসব প্রান্তিক নারীর পরিবার চলে এ শিল্পের ওপর, তাঁরা কেমন আছেন? আফরোজা পারভীন দুই শব্দে বললেন, ‘ভালো নেই!’
রাজধানীতে রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালনের তিন শাখা—মোহাম্মদপুর, বনানী ও বনশ্রী। মার্চের মাঝামাঝি থেকে তিন শাখাই বন্ধ। এ তিন শাখায় কাজ করেন দেড়শ প্রান্তিক নারী। করোনার প্রকোপ শুরুর দিকে আফরোজা পারভীন তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিতে অগ্রিম টাকাপয়সা দিয়ে ঘরে নিরাপদে থাকতে বলেন। কিন্তু করোনার প্রকোপ যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী হবে, সে ভাবনা তখন মাথায়ও ছিল না। গেল বৈশাখে পার্লার বন্ধ ছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে পার্লারগুলোতে যে ভিড়, তার বালাই নেই এবার। অথচ আগের বছরগুলোতে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কত আয়োজন। কত ব্যস্ততা। বৈশাখ ও ঈদে প্রায় ৮৫ লাখ টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালনের, জানালেন আফরোজা নিজেই।
আফরোজা পারভীন জানান, দেশে প্রায় ১০ লাখ বিউটি পার্লার আছে। সবারই একই অবস্থা। সবমিলিয়ে তাহলে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির আর্থিক ক্ষতি কত? এক নিশ্বাসে তাঁর উত্তর, ‘ধরা যাক, একটি স্যালন প্রতিদিন ৫০০ টাকা আয় করে। এক মাস বন্ধ থাকলে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে আর্থিক ক্ষতি হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর তিন মাসে তো তিন হাজার কোটি টাকা লস।’
শুধু বৈশাখ বা রোজার ঈদেই যে ব্যবসা হলো না, তা নয়। আফরোজা পারভীন মনে করেন, করোনার কারণে আসছে ঈদুল আজহা, বা ডিসেম্বরের বিবাহের মৌসুমটাও হারাবে বিউটি পার্লারগুলো। এ ছাড়া অন্য যেসব ইভেন্ট হয়, সেসবের কথা না হয় বাদই দিলেন তিনি!
করোনার প্রকোপের শুরুতে আফরোজা আশা করেছিলেন, হয়তো মাস দুয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আসবে। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘মার্চের মাঝামাঝি থেকে পার্লার বন্ধ। ভেবেছিলাম, মাস দুয়েকের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে। কর্মীদের অগ্রিম বেতন দিয়ে বাড়িতে পাঠালাম। আশাই তো মানুষের সাহস। ওরাও খুশি হয়েছিল। অন্তত দুই মাস তো খেতে পারবে, চলতে পারবে। এরপর লকডাউন, বৈশ্বিক অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম এটা লম্বা সময় ধরে চলবে। এ বছরই ব্যবসাটা করতে পারব না। বৈশাখ গেল, ঈদ চলে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে ব্রাইডাল সিজনটাও হারাব। প্রতিদিন দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে। চাইলেও সমাধান করতে পারছি না। ম্যাজিক দিয়ে তো আর এ অবস্থা কাটবে না।’
আফরোজা পারভীন জানান, বাংলাদেশে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের। এ শিল্পে ১০ লাখ উদ্যোক্তা যুক্ত। এর সঙ্গে জড়িত সৌন্দর্যবর্ধনের বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারীরা। সবমিলিয়ে বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। করোনার কারণে ১০ লাখ পরিবার আর্থিক ক্ষতিতে রয়েছেন। কিন্তু আফরোজার আক্ষেপ, এ শিল্পের দিকে তেমন দৃষ্টি নেই নীতিনির্ধারকদের।
আফরোজা বলেন, ‘আমার পার্লারে ১৫০ জন কাজ করে সংসার চালান। পার্লার বন্ধ থাকলে তাঁদের কতদিন আমি চালাতে পারব? আমি জানি না। কমার্শিয়াল স্পেসে পার্লার, ভাড়া কোথা থেকে দেব? আমাদের ইনকামও অত বেশি না। অর্ধেকের বেশি প্রডাক্টের মেয়াদ চলে যাবে। সৌন্দর্যবর্ধনের প্রডাক্টগুলো তিন মাস, ছয় মাস, তিন বছর—এমন মেয়াদের হয়। তিন মাস বা ছয় মাস মেয়াদের প্রডাক্ট তো এক্সপায়ারড হয়ে যাবে। সেসব ক্ষতি কীভাবে পোষাব?’
আফরোজার মতে, অনেকে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে বিলাসী ব্যবসা বললেও আদতে তা নয়। তাঁর ভাষায়, ‘মেয়েরা অন্তত প্রতি দুই মাসে একবার চুল কাটে। ত্বকের ট্রিটমেন্ট বিলাস নয়, হেলথ ইস্যু। চুল থেকে নখের যত্ন নেওয়া বিলাস নয়, এটা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছয় মাস যদি স্যালন বন্ধ থাকে, কী হবে মানুষের? মানুষ কি পরিচ্ছন্ন ও হেলদি থাকতে পারবে? নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও হেলদি রাখার জন্যই পার্লার।’
আক্ষেপ করে আফরোজা বলেন, ‘আমাদের পাশে কেউ নেই। কোনো অ্যাসোসিয়েশন নেই। একটা ফোরাম তৈরি হলেও এখনো সরকারের পক্ষ থেকে রেজিস্ট্রেশন না মেলায় প্ল্যাটফর্মটা ব্যবহার করতে পারছি না। এখানে নেতৃত্বের অভাব রয়েছে।’ সরকারিভাবে এ ইন্ডাস্ট্রিকে শিল্প ঘোষণার আহ্বান জানান তিনি।
তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আফরোজা পারভীন। ‘উজ্জ্বলা’ নামের একটি উদ্যোগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০১৭ সাল থেকে সহ-প্রতিষ্ঠাতা আদিত্য সোমের সঙ্গে প্রান্তিক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উজ্জ্বলা কাজ করে যাচ্ছে। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এই করোনাকালেও তারা থেমে নেই। অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন। প্রান্তিক নারীরা যাতে এ শিল্পের প্রতি বিমুখ না হন, সে জন্য নানা কর্মপরিকল্পনা করে চলেছেন। এ দুঃসময়ে প্রান্তিক নারীদের পাশে থাকার জন্য নানা প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ নিচ্ছেন।
সরকারের কাছে আফরোজা পারভীনের দাবি, ‘আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত যেন বিউটি পার্লারগুলোকে ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফ করা হয়। আমাদের পার্লারগুলোর বাড়ি ভাড়া যেন ৫০ শতাংশ মওকুফের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সিটি করপোরেশন এ উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের এ শিল্প ব্যবসা খাতে, অথচ এটা সেবা খাতের হওয়া উচিত। ব্যবসা খাতের হওয়ায় আমাদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে, সেবা খাতের হলে ৪ শতাংশ দিতে হতো। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, এ শিল্পকে যেন সেবা খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর করোনাকালে এ শিল্পের মানুষের জন্য সরকার যেন একটি তহবিল গড়ে তোলে। কারণ এখানে যাঁরা কাজ করেন, সবাই অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, অনেকে স্বামী পরিত্যক্তা। তাঁদের বাঁচার অধিকার রয়েছে। আশা করি, এ শিল্পের প্রান্তিক নারীদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেবেন।’
সরকারের যথাযথ সহযোগিতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি, এ আশা আফরোজা পারভীনের। করোনাকাল কেটে ফের আলোর মুখ দেখবে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব, এ প্রত্যাশা রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজার।