বানভাসি মানুষের দুর্দশা

97

করোনা মহামারীর মধ্যেই দেশে বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় বাস করছেন বানভাসিরা। অথচ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে নেই বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি। হাতেগোনা দু’চারজন পাশে দাঁড়ালেও তাদের দেয়া সাহায্যের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। ফলে দুর্যোগের এই দিনগুলোতে বানভাসিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বন্যা-উত্তর কিভাবে চলবেন, কী দিয়ে ঘরবাড়ি ফের নতুন করে নির্মাণ করবেন এই অনিশ্চয়তায় তারা চিন্তিত। পরিবার পরিজন নিয়ে বন্যাকবলিতরা দিশেহারা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৩৩টি জেলা প্লাবিত। উপজেলার সংখ্যা ১৬৫টি এবং ইউনিয়ন এক হাজার ৮৬টি। পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৩টি। আর ক্ষতিগ্রস্ত ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন। বন্যায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জুলাই থেকে দেশের অনেক এলাকা বন্যাকবলিত হয়। বন্যায় বিভিন্ন স্থানে ফসলাদি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গবাদিপশু, স্কুল-কলেজ, আসবাবপত্রসহ নানা জিনিসের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কারো ঋণের টাকায় গড়ে তোলা মাছের ঘের ভেসে গেছে। ওই সব মাছচাষি অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে বন্যায় পানিবন্দী হয়ে থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের কোনো দেখা নেই। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা কী খাচ্ছেন, কোথায় ঘুমাচ্ছেনÑ এসব নিয়ে যেন তাদের মাথাব্যথা নেই। বানভাসিদের জন্য সরকারিভাবে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ এলাকায় সেই ত্রাণ যথাযথভাবে বণ্টন করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত, বন্যা, করোনা বা চলমান রাজনীতি যেটাই হোক না কেন, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী সবার মধ্যে একটি হতাশা কাজ করছে। এই হতাশা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ তারা হারিয়ে ফেলছেন। যারা ব্যবসায়ী এবং একই সাথে রাজনীতিবিদ দেশের এমন পরিস্থিতিতে তারা মনে করছেন, তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা এখন পুরো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তারাই সংসদে যাচ্ছেন; যাদের সাথে মাঠপর্যায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অতীতেও জনগণের সাথে তাদের দূরতম সম্পর্ক ছিল না।
জনপ্রতিনিধি বলতে বোঝায় যারা নির্বাচিত হন জনগণের ভোটে। কিন্তু দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায়, বিশেষ করে বিগত দু’টি সংসদ নির্বাচনে নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ব্যত্যয় ঘটায় এখন যারা জনপ্রতিনিধি, তারা সেভাবে জনগণের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার তেমন গরজ বোধ করেন না। ফলে জনগণের প্রতি তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি কোনোটাই নেই। আগে দেশে ভোটের রাজনীতি মজবুত থাকায় যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন তারা ভোটের জন্য হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন, নিজ এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। বাস্তবতা হচ্ছে, এ মুহূর্তে দেশে জনপ্রতিনিধি বলতে যে কিছু আছে সেটিই জনগণ ভুলতে বসেছে। ফলে জনগণের নেতৃত্বদান, তাদের সাথে সম্পর্ক ও আস্থার যে জায়গাটা থাকে, সেটি এখন নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ফলে বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করার পেছনে যে রাজনৈতিক কারণ থাকে সেটি আর অবশিষ্ট নেই। এখন কিছু মানুষ সাহায্য করছেন শুধুই মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয়ে। ভোটের সংস্কৃতি শক্ত পাটাতনে দাঁড়াতে না পারায় জনগণের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের যে অঙ্গীকার থাকার কথা সাম্প্রতিক সময়ে তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে জনপ্রতিনিধিরা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বা তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার তাগিদ বোধ করছেন না। এই আচরণকে দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এ অবস্থার পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী হবে; বিশেষ করে সরকারের আচরণে এর দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটবে।