‘‘আমার জীবন আমাকে সব সময়ে মুগ্ধ করতে পারেনি, তাই জীবনকে আমি নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছি।” – কোকো শ্যানেল
ওপরের উক্তি বাস্তবিকই এক দর্পণ; এতেই বিম্বিত জীবনকে তাঁর মতো করে গড়ে এক নারীর আদ্যন্ত। প্রায় পথশিশু থেকে নিজেকে বৈভব-শিখরে উন্নীত করেছেন বিস্ময়কর মুনশিয়ানায়। ঘাত-প্রতিঘাত পেরোতে পেরোতে নিজেকে প্রত্যয় দৃঢ় করেছেন। সুযোগ হাতছাড়া না করে সদ্ব্যবহার করেছেন। সমাজের নিচুতলার তকমা সত্ত্বেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কৌলীন্যের চৌহদ্দি। রাজপুত্র আর অভিজাত পুরুষেরা তাঁর সঙ্গ পেতে বেচাইন থেকেছেন।
রহস্যময় নারীর পরিচয়ই তাঁকে বিশ্ববিশ্রুত করেছে। অথচ কোকো শ্যানেল নামের এই ভুবনমোহিনী ফ্যাশন ডিজাইনারের বহুরূপ আমাদের অজ্ঞাত। শ্যানেলের ১৩৭তম জন্মদিনের অবকাশে আলো ফেলার প্রয়াস তাঁর জীবনের অন্য সব অধ্যায়ে।
সরল অথচ আরামদায়ক
এটাই শ্যানেলের ডিজাইনের মূলমন্ত্র। এই বিশিষ্টতায় মাত করেছেন প্যারিসের ওত্ কতুর পরিমণ্ডল। ১৯২০-এর দশকে এসে শ্যানেলের টার্নওভার দাঁড়ায় কয়েক কোটি ডলার। সে সময় কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২০০০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরই মধ্যে কেবল পোশাকের নকশা নয়, শ্যানেল সাম্রাজ্যে যুক্ত হয় কাপড়ের মিল, সুগন্ধি আর গয়নার কারখানা। যদিও তাঁর আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে ১৯২১ সালে বাজরে ছাড়া শ্যানেল ফাইভ নামের সেই অবিস্মরণীয় সুগন্ধি। শতবর্ষের সরণিতেও যার আবেদন অবিকল।
এখানে বলে রাখা ভালো, শ্যানেলই বিশ্বের প্রথম ফ্যাশন ডিজাইনার যিনি সুগন্ধি বাজারে ছাড়েন। তাও চিরাচরিত বোতল আর মোড়কের ধারণাকে নস্যাৎ করে। সেই সময়ে প্যারিসের বিখ্যাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর গ্যালারি লাফায়েতের মালিক থিওফাইল বেদারের মাধ্যমে পরিচয় হয় ব্যবসায়ী পিয়ের ওয়ারটাইমারের সঙ্গে। পিয়ের এবং তাঁর ভাই পলের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করেন শ্যানেল। এর আওতায় শ্যানেল ফাইভের উৎপাদন, বিপণন ও বিতরণের দায়িত্ব পায় দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান বোজোয়া। ফলে আয়ের সিংহভাগই চলে যায় পিয়ের ভাইয়ের কাছে। মাত্র ১০ শতাংশ পেতেন শ্যানেল। এ নিয়ে তাঁর বিস্তর উষ্মা ছিল।
সম্পর্ক
একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙতে তিনি গড়েছেন নতুন নতুন সম্পর্ক। তবে কোনো সম্পর্ককেই তিনি একেবারে শেষ করে দেননি বা নতুন কাউকে পাওয়ার আনন্দে বল্গাহীন হয়ে পুরোনোকে বিস্মৃত হননি। এই তালিকায় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য নাম মিসিয়া সার্ত। তিনি ছিলেন স্প্যানিশ চিত্রকর হোসে-মারিয়া সার্তের স্ত্রী। উভয়েই কনভেন্ট স্কুলে পড়ার কারণে বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। দুজনেরই ছিল মাদকের প্রতি আসক্তি। ১৯৩৫ সাল নাগাদ মাদক গ্রহণ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় শ্যানেলের।
তাঁর নাম কোকো হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে একটি ঘটনা। প্যারিসে একবার এক জাঁকজমকপূর্ণ কোকেন পার্টি দিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে কোকো শব্দটি জুড়ে যায়। এটাই হয়ে ওঠে তাঁর মূল নামের অংশ।
সুগন্ধি শ্যানেল ফাইভ দিয়ে বিপ্লব ঘটানোর দুবছরের মাথায় এক নতুন জগতে প্রবেশ করেন শ্যানেল। সেটা ছিল অভিজাত ব্রিটিশদের বলয়। এই বৃত্তে প্রবেশের চাবি ছিল ভেরা বেট লম্বার্ডি। মার্কেস অব কেমব্রিজের কন্যা। তাঁর মাধ্যমেই শ্যানেলের বন্ধুত্ব হয় তরুণ ব্রিটিশ রাজনীতিক উইন্সটন চার্চিলের সঙ্গে। এই তালিকায় আরও ছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস অষ্টম এডওয়ার্ড এবং ডিউক অব ওয়েস্টমিনিস্টার হিউ রিচার্ড আর্থার গ্রভেনার।
প্রিন্স অব ওয়েলস আর ডিউকের সঙ্গে তিনি সমান্তরালে প্রেম করেছেন। যুবরাজ তাঁকে দিয়েছেন বেশুমার উপহার। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাররোকোব্রুন-ক্যাপ-মার্টিনে তাঁর জমি উপহার দেন শ্যানলকে ডিউক। স্থপতি রবার্টস্ট্রেইৎজকে দিয়ে সেখানে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন শ্যানেল। কৈশোরের অনেকটা দিন যে অনাথাশ্রমে কাটিয়েছিলেন, সেই ওবাজিনের স্মৃতিকে সজীব রাখেন এর নকশায়। নাম দেন লা পজা বা বিরাম। দীর্ঘদিন বাদে ১৯৩৫ সালে এই বাড়িটি তিনি বিক্রি করে দেন প্রকাশক এমারিরিভসের কাছে। এমারি সেটাকে রূপান্তর করে ডালাস মিউজিয়াম অব আর্টে।
তাঁর সম্পর্ক ছিল রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের জ্ঞাতিভাই ডিউক দিমিত্রি পাভলোভিচ রোমানভের সঙ্গে। এই সময়ে আরও পরিচয় হয় স্যামুয়েল গোল্ডউইনের সঙ্গে। স্যামুয়েলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে দুবার হলিউডে গিয়ে এমজিএম স্টারসের জন্য কস্টিউম ডিজাইন করেছেন। এ জন্য তাঁকে সে সময়ে দেওয়া হয় ১০ লাখ ডলার। আজকের হিসেবে কম করে হলেও, সাড়ে সাত কোটি ডলার। ১৯৩১ সালে ‘টুনাইট অর নেভার’ ছবিতে গ্লোরিয়া সোয়ানসন, ১৯৩২ সালে ‘গ্রিকস হ্যাড আ ওয়ার্ড ফর দেম’ ছবিতে ইনা ক্লেয়ারের জন্য পোশাকের নকশা করেন। এমনকি গ্রেটা গার্বো আর মারলিন দিয়েত্রিশ তাঁর নিয়মিত ক্লায়েন্টে পরিণত হন। তবে হলিউডে তিনি সুবিধা করতে পারেননি। যদিও সেটা স্বীকার না করে হলিউডকে ‘নিম্ন রুচির রাজধানী’ বলে সমালোচনা করেন।
এমজিএম স্টারসের জন্য কস্টিউম ডিজাইন করার জন্য তাঁকে সে সময়ে দেওয়া হয় ১০ লাখ ডলার। ১৯৩১ সালে ‘টুনাইট অর নেভার’ ছবিতে গ্লোরিয়া সোয়ানসন, ১৯৩২ সালে ‘গ্রিকস হ্যাড আ ওয়ার্ড ফর দেম’ ছবিতে ইনা ক্লেয়ারের জন্য পোশাকের নকশা করেন শ্যানেল।
এরপরও তিনি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। বিখ্যাত ফরাসিপরিচালকজঁরেনোয়া আর ইতালির লুচিনোভিসকন্তির ছবির জন্য। এ ছাড়াতাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল কবি পিয়েররিভারদি আর ইলাস্ট্রেটর ও ডিজাইনার পল ইরিবির সঙ্গে। পাবলো পিকাসো ওসালভাদর দালি আর জঁককতোর সঙ্গেও কাজের এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল কোকো শ্যানেলের।
তিরিশের দশকেও শ্যানেলের ব্যবসা ছিল রমরমা। তবে এই দশক যত এগিয়েছে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শ্যানেল। কারণ তত দিনে এসে গেছে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নবীন ডিজাইনার এলসা শিয়াপারেল্লি। উদ্ভাবনী নকশা, সময়ের সুবাস আর তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে তাঁর নকশা ক্রমেই জয় করে নিচ্ছিল ফ্যাশনপ্রিয়দের হৃদয়। এরই মধ্যে বাজতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।