আমাদের এন্ড্রু কিশোর

229

গান দিয়ে কয়েকটি প্রজন্মের শৈশব আর কৈশরকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। আমাদের জনসংস্কৃতির ভেতরে কেমন ছিল এই শিল্পীর প্রভাব? ঠিক কী কী কারণে জনসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি? তাঁর মৃত্যুর পর এই লেখায় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বুলবুল সিদ্দিকী।

‘ওগো বিদেশিনী
তোমার চেরি ফুল দাও
আমার শিউলি নাও
দুজনে প্রেমে হই ঋণী’
গতকাল সন্ধ্যা থেকে এই কয়েকটি লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকের মতোই আমিও এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ায় বেশ কষ্টকর একটি অনুভূতি মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এন্ড্রু কিশোরের আরও অনেক অনেক বিখ্যাত এবং জননন্দিত গানের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। আমাদের সবার মাথায়ই সময়ের একটা অনুভূতি অনেকটা স্থায়ী হয়ে রয়ে যায়। সেই অনুভূতি থেকে হয়তো আর আমরা বের হতে পারি না কিংবা বের হলেও বারবার সেই অনুভূতির কাছে ফিরে আসতে চাই ওই সময়কে ধারণ করার জন্য। এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর গান আমার কাছে তেমনই একটি অনুভূতির বিষয়, যা আমাকে দুর্দান্ত একটি কৈশোর এবং বাংলা সংগীতের প্রতি এক অভাবনীয় ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছে। সংগীত যেমন শিল্পীর কাছে একটি সাধনার বিষয়, ঠিক তেমনি শ্রোতার কাছে অভাবনীয় কিছু সংগীত উপহার দেওয়ার মাধ্যমে শ্রোতা তৈরির পেছনেও শিল্পীর ভূমিকা অপরিসীম। আর শ্রোতা তৈরি করার পেছনে একজন সংগীতশিল্পীর যে পরিমাণ অবদান থাকে, সেটি বোধ করি খুব অল্পসংখ্যক সংগীতশিল্পীর ভাগ্যেই জোটে। ঠিক তেমনই একজন শিল্পী হিসেবে এন্ডু কিশোরের গান শুনে আমরা বড় হয়েছি। এ কারণেই আমাদের সমসাময়িক অনেকের কাছেই এন্ডু কিশোর কেবল একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, বরং প্রতিটি কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধিকালীন দুঃখ ও ভালোবাসার অনুভূতির এক উৎস ছিলেন। আমাদের তারুণ্য যেন এন্ড্রু কিশোরের গান দিয়েই পরিপূর্ণ ছিল। ফলে এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার পর থেকে কেবলই আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন এন্ড্রু কিশোরকে হারাইনি, বরং সেই আশি ও নব্বই দশকের আমাদের তারুণ্যভরা দুর্দান্ত অনুভূতি ও ভালো লাগার সময়টাকে হারিয়ে ফেলেছি।

আশির দশকের কিংবা তার আগে থেকেই আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে রেডিওর ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেই সময় আমাদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল রেডিও। কেননা, টেলিভিশন তখনো আমাদের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। তখন রেডিও মানেই হলো চলচ্চিত্রের গান, আর চলচ্চিত্রের গান মানেই যেন ছিল এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদীসহ আরও অনেক জনপ্রিয় শিল্পীদের গান।

এখানে আমরা আরও অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর নাম উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সেই সময়ের তরুণ-তরুণী এবং আমাদের আগের প্রজন্মকে যেভাবে একটা মোহাবিষ্ট সময়ের মধ্যে বসবাস করতে সহায়তা করেছেন, আদতেই তা অভাবনীয়। মনে পড়ে, দুপুর হলেই আমি আমার ছোট্ট রেডিওটি নিয়ে পাশের ঘরে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গান শুনতে বসে যেতাম। আমার কাছে প্রায় প্রতিটি দুপুর এভাবেই এন্ড্রু কিশোরের গানময় হয়ে উঠত। সে সময় আমরা রেডিওতে গান শুনতে শুনতে একটা মজার খেলাও খেলতাম: উপস্থাপক সংগীতশিল্পীর নাম বলার আগেই কণ্ঠ শুনেই আমাদের বলতে হতো যে ওই শিল্পীর নাম কী। বলার কথা হলো, এন্ড্রু কিশোরের গান বা তাঁর গলা শুনে তাঁর নাম বলতে পারত না—এমন মানুষ খুব কমই ছিল তখন।

সময়টা এমন ছিল যে ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে আমাদের গ্রামীণ সমাজের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে রেডিওর কল্যাণে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এন্ড্রু কিশোরের হৃদয় নিংড়ানো গান। ছোটবেলায় যখন নানাবাড়ি বা দাদাবাড়িতে যেতাম, কৃষকের মাঠ থেকে তখন প্রায়ই অনেক তরুণের খালি ও মিঠে গলায় গাওয়া এন্ড্রু কিশোরের গান ভেসে আসত কানে। আমি আজও যেন সেই সুর শুনতে পাই।

এন্ড্রু কিশোর ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। তাঁর সংগীতের জনপ্রিয়তা এমন ছিল যে চলচ্চিত্রের সংগীতে পুরুষ কণ্ঠ মানেই ছিল এন্ড্রু কিশোর। সংগীতপাগল অনেক মানুষ কেবল এন্ডু কিশোরের গান শোনার জন্যই চলচ্চিত্র দেখতে হলে যেতেন। এমনও শোনা যায় যে এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠের সঙ্গে যেন মানানসই হয়, সে বিষয় চিন্তা করে অনেক চলচ্চিত্রের নায়ক ঠিক করা হতো। সেই সময় আমাদের চলচিত্রের এক মহাসমারোহও ছিল বটে। গণমানুষের শিল্পী হয়ে উঠতে পারা একজন শিল্পীর জন্য এক পরম পাওয়া, যা আমরা এন্ড্রু কিশোরের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। আমরা যদি বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট হলের জনসংস্কৃতির ধারণার দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের গানকে দেখি, তাহলে দেখতে পাই যে তিনি একইভাবে শহুরে সমাজের উঠতি তরুণ–তরুণীদের পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজের মানুষের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা একটি ভিন্ন ধরনের জনসংস্কৃতির রূপায়ণ। প্রচলিতভাবে জনসংস্কৃতি বলতে যে অধিকাংশের সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, সে বিচারে আমরা এন্ড্রু কিশোরকে উপস্থাপন করতে পারি।

আমরা যদি বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট হলের জনসংস্কৃতির ধারণার দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের গানকে দেখি, তাহলে দেখতে পাই যে তিনি একইভাবে শহুরে সমাজের উঠতি তরুণ–তরুণীদের পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজের মানুষের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা একটি ভিন্ন ধরনের জনসংস্কৃতির রূপায়ণ। প্রচলিতভাবে জনসংস্কৃতি বলতে যে অধিকাংশের সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, সে বিচারে আমরা এন্ড্রু কিশোরকে উপস্থাপন করতে পারি।

আবার একটু ভিন্নভাবে যদি আমরা এন্ড্রু কিশোরের গানের প্রেক্ষাপটকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তাহলে দেখতে পাই, যে সময়টাতে এন্ড্রু কিশোর তাঁর ক্যারিয়ারের শীর্ষে ছিলেন, সেই সময়টাতে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সামগ্রিক জনপ্রিয়তার বিচারে বর্তমানের তুলনায় বেশ ভালো একটি অবস্থানে ছিল। এর মানে হলো এমন তুমুল জনপ্রিয় সংগীতের পেছনে আসলে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের ধারণাও বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, যার অভাব আমরা পরবর্তীকালের চলচ্চিত্রের সংগীত কিংবা চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সাফল্য না পাওয়ায় সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দেখতে পাই। সেই একই এন্ড্রু কিশোর ক্যারিয়ারের শেষের দিকে আমরা অত ভালো জনপ্রিয় কিংবা কালজয়ী সংগীতের উপস্থিতি দেখতে পাই না, কেননা নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই আমাদের চলচ্চিত্র নানাবিধ সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। এ সময় হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখার সংস্কৃতির প্রতি একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের মধ্যে অনীহা প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। যদিও এর সঙ্গে চলচ্চিত্রের এবং সংগীতের পাইরেসি বিষয়টি যুক্ত ছিল।

১৯৮৩ সালে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু যেভাবেই আমরা এন্ড্রু কিশোর সংগীতকে দেখতে চাই না কেন, তাঁর মতো দ্বিতীয় একজন শিল্পীকে আমরা আর দেখতে পাব কি না, সে বিষয়ে যথার্থই সন্দেহ রয়েছে। অনেককেই বলতে শুনি যে মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে, কিন্তু এন্ড্রু কিশোরের মতো শিল্পীর চলে যাওয়া এ সমাজে যে শূন্যতার সৃষ্টি করবে, সেই শূন্যতা পূরণ করার মতো মেধা ও মনন এই সমাজের আছে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে আমাদের এক অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়ে গেল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো ব্রিটিশ কবি রালফ হজসনের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘টাইম ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান’। সময় তার নিজস্ব গতিপ্রবাহে চলতে থাকবে, আমাদের সেই সোনালি দিনগুলো আমরা আর ফিরে পাব না। সংস্কৃতি যেমন ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং নতুনের সঙ্গে অভিযোজিত হতে থাকে, একইভাবে পরবর্তী প্রজন্ম যখন আধুনিকতার মাধ্যমে সংগীতের নতুন নতুন ধারার সঙ্গে অভিযোজিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময় আমাদের প্রজন্মের সোনালি সময়কে রাঙিয়ে দেওয়া এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ায় দুঃখভারাক্রান্ত মনে তাঁকে স্মরণ করছি আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি আমাদের তারুণ্য ও যৌবনকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে তোলার পেছনে আপনার অভাবনীয় অবদানের জন্য।