কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে সাত বছর আগে- এক বছরে প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন ৮টি প্রতিষ্ঠানকে। বিমানের চুক্তিতে নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের নির্ধারিত বেতনের অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয়েছে প্রতি মাসেই। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া মোটা অঙ্কের মাসিক পারিতোষিক তুলে নিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যানও।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে ২০১০- ২০১১ অর্থ বছরের হিসেবের ওপর মোট ১২টি অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত ২৩০ কোটি ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৯৪ টাকা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ট্রাভেল ফ্যাসিলিটেটর কোম্পানিকে প্রদত্ত ফি, উড়োজাহাজ লিজ দাতার বিল এবং ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রদত্ত কমিশনের ওপর ভ্যাট এবং আয়কর কর্তন না করায় ১০৬ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার ২২০ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়। এজন্য কমিটির পক্ষ থেকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এনবিআর থেকে ভ্যাট অব্যাহতির বিষয়ে মতামত গ্রহণ করে এজি অফিসে উপস্থাপন এবং ট্যাক্সের বিষয়টি নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়। বিমান কোম্পানির টিকিট ও আসন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া (জিডিএস) কোম্পানি মেসার্স গ্যালিলিও/ট্রাভেল পোর্টকে টিকিট বিক্রি, বুকিং এবং বুকিং বাতিল ফির বিল যাচাই বাছাই এবং প্রমাণাদি ছাড়াই বিল দেয়া হয়েছে ওই সময়। এই অনিয়মের কারণে ক্ষতি হয়েছে ৬৯ কোটি ৭৪ লাখ ১৮ হাজার ২৫ টাকা টাকা। কমিটি এটিও নিষ্পত্তির সুপারিশ করে।
বৈঠকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের নিজস্ব মালিকানাধীন ট্রাভেল ফ্যাসিলিটেটর মেসার্স এ্যাবাকাস বাংলাদেশ এনএমসি লিমিটেডের নেটওয়ার্ক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও জিডিএস সফটওয়্যার প্রোভাইডার কোম্পানির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ফি দেয়ায় ৩৪ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৫ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানানো হয়। আর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের চেয়ারম্যানকে অনিয়মিতভাবে মাসিক পারিতোষিক দেয়ায় সংস্থার ২৬ লাখ ২৫ হাজার ৮০৬ টাকা এবং চুক্তিবদ্ধ কর্মকর্তাদের চুক্তিকৃত হারের অতিরিক্ত হারে বেতন প্রদানে সংস্থার ১২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয। কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়।
সরকারি কোটা নীতিমালা অনুসরণ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়া ২৫৪ জন কর্মচারীকে অনিয়মিত নিয়োগ ও বেতন ভাতা প্রদান করায় সংস্থার ৯ কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কমিটি অনিয়মিতভাবে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের নিয়মিত করে অনধিক তিন মাসের মধ্যে অগ্রগতি কমিটিকে জানানোর সুপারিশ করে। কার্গো ভাড়া গ্রহণের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে অনুমিত রেটের কম রেটে ডলারকে টাকায় রুপান্তর করে ভাড়া গ্রহণ করাতে সংস্থার ৫ কোটি ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩২৫ টাকা ক্ষতি হয়েছে। কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) প্রণীত নিয়ম মেনে সমন্বয় করে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির সুপারিশ করে। এছাড়া কাজ ছাড়াই পরামর্শক ফি প্রদানের নামে মেসার্স এয়ারলজিককে অর্থ প্রদান করায় সংস্থার ক্ষতি হয় ৪৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রকৃত অধিকাল ঘণ্টার চেয়ে বেশি এবং প্রাপ্য হারের চেয়ে বেশি হারে অধিকাল ভাতা দেয়ায় সংস্থার ১ কোটি ৮৪ লাখ ৩১ হাজার ৫১ টাকা ক্ষতি হয়।
যথাসময়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় লিজে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সরকারের রাজস্ব, লিজ প্রিমিয়াম বিবিধ পাওনা বাবদ ৬৩ লাখ ৭৭০ টাকা আদায়যোগ্য, ইজারাদারদের কাছ থেকে মূসক ও আয়কর আদায় না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৮৪০ টাকা ক্ষতি এবং ইজারা মূল্যের উপর প্রযোজ্য ভ্যাট ও উৎসে করের অর্থ দীর্ঘদিন ধরে আদায়ে ব্যর্থতায় ২ কোটি ২২ লাখ ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা ক্ষতি মর্মে উত্থাপিত অডিট আপত্তির প্রেক্ষিতে কমিটির পক্ষ থেকে অনধিক তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়।
কমিটির সভাপতি ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী, মো. আফসারুল আমীন, মো. শামসুল হক টুকু, রেবেকা মমিন এবং বেগম ওয়াসিকা আয়েশা খান অংশ নেন। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মহিবুল হক, ডেপুটি সিঅ্যান্ডএজি মো. জাকির হোসেন, অডিট অফিস এবং জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।