যে গান জেগে উঠতে বলে

32

গুদামঘরে উদাম গায়ে নেচে নেচে যে মিউজিক ভিডিওটি বানিয়েছেন মার্কিন সংগীতশিল্পী ডোনাল্ড গ্লোভার, তা রীতিমতো ঝড় তুলেছে বিশ্বজুড়ে। দুই সপ্তাহ ধরে বিলবোর্ডের শীর্ষ স্থান দখল করে আছে তাঁর ‘দিস ইজ আমেরিকা’ গানটি।

অভিনেতা, কমেডিয়ান, লেখক, র‍্যাপার, ডিস্কো জকি—অনেক পরিচয় ডোনাল্ড গ্লোভারের। মঞ্চে গান করেন ‘চাইল্ডিশ গ্যাম্বিনো’ নামে। ২০০২ সাল থেকে সক্রিয় এই শিল্পীর কোনো গান এই প্রথম এত সাড়া ফেলেছে।

এ মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত হয়েছে গানের ভিডিওটি। ধারণা করা হচ্ছে, গানের মাধ্যমে এমন রাজনৈতিক বক্তব্য সাম্প্রতিক সময়ে আর কেউ দেননি। তবে শিল্পী গ্লোভার মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তাঁর হাবভাব বলছে, তাঁর কাজ তিনি করেছেন। এবার লোকে যা বোঝার বুঝুক।

আর সেই থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দর্শকেরা খুঁজতে বসে গেছেন গানের ভিডিওর মানে। দৃশ্যের পর দৃশ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা বলছেন, গানটি আসলে আমেরিকার বাস্তবতার চিত্রই তুলে ধরেছে।

গান শুরু হয় এমন একটি দৃশ্য দিয়ে—খালি গুদামঘরের একটি চেয়ারে গিটার হাতে নিয়ে বসে পড়ে একজন। মিউজিক শুরু হয়। এর মধ্যে উদাম গায়ে দেখা যায় গ্লোভারকে। অস্বাভাবিক দেহভঙ্গিতে অতিরঞ্জিত মুদ্রায় নাচতে থাকেন তিনি। একসময় সামনে এসে গিটারওয়ালাকে গুলি করে বসেন! এরপর শুরু হয় মূল গান—‘দিস ইজ আমেরিকা’।

দেখা যায়, পিস্তলটিকে সযত্নে লাল কাপড়ে মুড়ে নিয়ে যায় একজন। আর অন্যদিকে মৃতদেহটিকে দুজন লোক এসে টেনে টেনে নিয়ে যায়। আমেরিকায় যেভাবে জীবনের চেয়ে বন্দুকের মূল্য বেশি হয়ে গেছে, তারই ইঙ্গিত দেয় এই দৃশ্য। কাপড়ের লাল রং আমেরিকার ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধিত্ব করে, যারা কিছুতেই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নয়। তাই কিছুদিন পরপরই আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র মানুষ এসে মানুষ মারছে। কারণ, দেশটিতে খুব সহজেই যে কেউ যেকোনো মাত্রার অস্ত্র কিনতে পারে।

গানের আরেকটি দৃশ্যে কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে মেরে ফেলেন গ্লোভার। এই দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৫ সালে সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটনে কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জায় যাওয়া হামলার কথা।

যে গুদামঘরে শুটিং হয়েছে, তার অধিকাংশ স্তম্ভ সাদা। অনেকে মনে করছেন, এটি সেই ভিতের প্রতিনিধি, যার ওপর ‘ফাউন্ডিং ফাদার’রা আমেরিকাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। সংবিধানে তাঁরা লিখেছিলেন, সব মানুষ সমান। অথচ তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন দাসপ্রভুও।

গানে গ্লোভার প্রথম যে গুলিটি করেন, তার দেহভঙ্গি ছিল জিম ক্রোর মতো। কে এই জিম ক্রো? আমেরিকায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে দাসপ্রথা যখন বিলুপ্ত হয়, তখনো শ্বেতাঙ্গদের মনে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অনেক ঘৃণা অবশিষ্ট ছিল। কালোদের দাস বানিয়ে আর খাটানো যাচ্ছে না তো কী হয়েছে, তাদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতে তো আর বাধা নেই! তাই শ্বেতাঙ্গ অভিনয়শিল্পীরা আবিষ্কার করলেন এক চরিত্র, জিম ক্রো।

জিম ক্রো দেখতে ক্রো বা কাকের মতো। এভাবে ১৮ ও ১৯ শতকজুড়ে শ্বেতাঙ্গ শিল্পীরা মুখে কালি মেখে কৃষ্ণাঙ্গদের বিদ্রূপ করতেন। তখনকার চলচ্চিত্রগুলোতে এর প্রমাণ আজও পাওয়া যায়।

‘দিস ইজ আমেরিকা’ গানের ভিডিওতে কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র জিম ক্রোর সঙ্গে ডোনাল্ড গ্লোভারের মিল‘দিস ইজ আমেরিকা’ গানের ভিডিওতে কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র জিম ক্রোর সঙ্গে ডোনাল্ড গ্লোভারের মিলমিনিট চারেকের এই ভিডিওতে ডোনাল্ড গ্লোভারের গান ও দৃষ্টিনন্দন আফ্রিকান নাচের বাইরে পেছনে যদি একটু চোখ যায়, তাহলে দেখা যাবে আমেরিকার সামাজিক অস্থিরতার চিত্র। সেখানে টাকা উড়ছে, গুলি চলছে, ত্রস্ত মানুষ ছোটাছুটি করছে, মানুষ আত্মহত্যা করছে, ঘোড়ায় চড়ে চলে যাচ্ছে মৃত্যুদূত।

কিন্তু সেগুলোকে ঢেকে রাখছে ডোনাল্ডের গান আর নাচ, ঠিক যেভাবে বিনোদনদুনিয়া মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মানুষ মজে আছে তার পোশাকের চাকচিক্যে, বৈভবে। আসল সমস্যাগুলো তার চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে সন্ত্রাসের কিছু দৃশ্য ভাইরাল হচ্ছে। তা দেখে মানুষ হতভম্ব হচ্ছে। কেবল এটুকুই, অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

গানের শেষ দৃশ্যে ডোনাল্ড গ্লোভার ছুটে চলেছেন অন্ধকার পথে, পেছনে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। গান শেষ হয় এই কথা দিয়ে—‘এই পৃথিবীতে তুমি কেবল একজন কালো মানুষ। কেবল একটি বারকোড। কেবল একটা বড় কুকুর’—এখনো অনেকের দৃষ্টিতে অনেকে মানুষের মর্যাদা পায়নি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ভিডিও দেশে দেশে এত জনপ্রিয় হলো কেন? ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রতিটি দেশেই তো একই চিত্র। অস্থিরতা ও তার প্রতি উপেক্ষা হাতধরাধরি করে চলছে বর্তমানে। অথচ মানুষ ঘুমিয়ে আছে। চাইল্ডিশ গ্যাম্বিনো ওরফে ডোনাল্ড গ্লোভারের এই গান তাদের আসলে জাগাতে চায়।